Monday, February 8, 2010

আফগানি বেলালের নরওয়ে পাড়ি জমানোর গল্প

দুর্দান্ত স্কিল আর দুরন্ত গতি অন্যদের চেয়ে তাকে আলাদা করে দেয়! উচ্চতায় তেমন আহমরি নন। তারপরও মাঠের ওই ২২ ফুটবলারের মধ্যে তাকে চিনে নিতে সমস্যা হয় না। আসলে পারফরমেন্সই তাকে ৯০ মিনিটের খেলায় বারবারই নিয়ে আসে আলোচনায়। যেমনটা হচ্ছে এসএ গেমস ফুটবলে। এরই মধ্যে নিজেকে চিনিয়েছেন বেলাল আরজু। নরওয়ের দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব আসকের হয়ে খেলা আফগানিস্তানের এই স্ট্রাইকার প্রতি ম্যাচেই পেয়েছেন গোল।
ভারতের বিপক্ষে গোল দিয়ে শুরু। প্রথম ম্যাচে তার দেয়া ওই গোলেই জেতে আফগান ফুটবল দল। এরপর গেমসের ফুটবলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের বিপক্ষে আবারও ম্যাজিক। এবার করেন দুই গোল। গ্রুপ পর্যায়ের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আফগানরা জেতে ২-০ গোলে। এখানেও দু্ই গোল তার। এরপর সেমিফাইনালেও সেই বেলালই ত্রাণকর্তা। তার গোলেই মালদ্বীপকে হারিয়ে আফগানিস্তান উঠে গেছে গেমসের ফাইনালে।
আজ বাংলাদেশের ডিফেন্ডারদের বড় পরীক্ষা। ৪ ম্যাচে ৬ গোল করা এই স্ট্রাইকার গতকাল বলছিলেন, ‘না, আমার গোলক্ষুধা মেটেনি! বাংলাদেশের বিপক্ষে ফাইনালেও ঝড় তুলতে চাই।’তাহলে ফাইনালে আফগানিস্তানকেই এগিয়ে রাখছেন? অবশ্যই! মাতৃভূমি বলে কথা। তবে বাংলাদেশও ভালো দল। আশা করছি স্বর্ণপদকের লড়াই বেশ জমে উঠবে।
লড়াই জমে উঠবে কিনা সেটা সময়েই জানাবে। কিন্তু আপনি যে এবারের সেরা ফুটবলার সেটা প্রায় নিশ্চিত...
আসলে আমি ঠিক এভাবে দেখছি না। দেখুন যদি আফগানিস্তান চ্যাম্পিয়ন হতে না পারে তাহলে সেরা খেলোয়াড় হয়েও স্বস্তি পাব না। আসলে আমার এই যে পারফরমেন্স, ধারাবাহিকভাবে গোল করে যাওয়া তার কৃতিত্ব কিন্তু সতীর্থদেরই। তাছাড়া আমাদের অনূর্ধ্ব-২১ দলের কোচ ইলিয়াস আহমেদ মাচোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন! এ কারণেই আমি সবসময় মনে করি এটা আমার একার নয়, সবার সাফল্য।
দলের প্রসঙ্গ থাক, আফগানিস্তান থেকে আপনার নরওয়েতে পাড়ি জমানোর গল্পটা শুনতে চাই?
আহ! এটা অনেক লম্বা গল্প! ছোট করে যদি বলতে যাই তাহলে বলতে হয়, আমার বাবা আফগানিস্তানের রাজনীতিবিদ। আর এটাই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়! আমার বয়স যখন ৩ বছর, তখন ছাড়তে হয় আফগানিস্তান। দেশ থেকে একরকম তাড়িয়েই দেয়া হয় আমাদের। সেটা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, যা এ মুহূর্তে বলতে চাই না। আফগানিস্তান ছেড়ে প্রথমে আমরা মানে আমাদের পরিবারের মানুষরা আশ্রয় নেই পাশের দেশ পাকিস্তানে। এরপর সেখান থেকে চলে যাই ইরানে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি আমরা। আর সবশেষে বাবা-মা ৮ ভাইবোনকে নিয়ে এখন নরওয়েতে এসে স্থায়ী হয়েছি।
তাহলে আপনার শৈশব অনেকটা যাযাবরের মতো কেটেছে?
আসলে আমার শৈশবের স্মৃতি মনে করতে চাই না। দেশ ছেড়ে অন্যের দেশে থাকা যে কতটা কষ্টের সেটা যারা থাকছেন তারাই জানেন। পাকিস্তানের সময়গুলো দুঃসহ কেটেছে আমাদের। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে থাকতে হয়েছে আমাদের। সেখানে বন্ধু বলে কেউ ছিল না। ইরানেও দুবেলা খাবারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে আমার বাবা ও বড় ভাইদের। এক সময় মনে হয়েছে আমাদের জন্মানোই যে পাপ!
এখন সময় তাহলে ভালো কাটছে?
আসলেই অনেক সুখে আছি এখন। যখন আমার আত্মীয়স্বজনদের দেখি তখন ভাগ্যবানই মনে হয়। আমাদের পরিবারের সবাই নরওয়ে পাড়ি জমালেও আত্মীয় অনেকেই এখন বেঁচে থাকার লড়াই করছেন আফগানিস্তানে। অসহায় ওই মানুষদের কথা যখন ভাবি তখন মন খারাপ হয়ে ওঠে। ওরা প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যুর ভয়ে কাটাচ্ছেন!
তাদের জন্য কি কিছু করছেন?
আমার সাধ্যমতো আমি সবাইকে সাহায্য করছি। আল্লাহ সামর্থ্য দিলে অবশ্যই আরও বেশি কিছু করব। এটা ঠিক ইউরোপে শান্তিতে আছি। কিন্তু মাঝেমধ্যে ভাবি সত্যিই কি সুখে আছি? যুদ্ধ কি কারণে হয়েছে কিংবা হচ্ছে জানি না। কিন্তু আমি মনে করি এখন শান্তি দরকার।
নরওয়ের ক্লাবে খেলছেন। সেখানকার জাতীয় দলে খেলার প্রস্তাব এলে কি করবেন?
প্রস্তাব কিন্তু এসেছিল। অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমার লক্ষ্য আসলে আফগানিস্তানের হয়ে খেলা। হ্যাঁ, এটা ঠিক নরওয়ের নাগরিত্ব নিয়েছি। কিন্তু ভবিষ্যতেও এমন প্রস্তাব এলে না করব। আমি একজন আফগান হিসেবে গর্বিত!
ইউরোপে খেলছেন, আপনার হিসাবে কারা এগিয়ে লাতিন ফুটবল নাকি ইউরোপিয়ান ফুটবল?
আমি তো বলব ইউরোপিয়ান ফুটবলই এগিয়ে। দেখুন সেখানে প্রতিযোগিতা কত কঠিন। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় দুটো দেশই রাজত্ব করছে।
সেই দুই দেশের মধ্যে আপনার প্রিয় কোনটি—ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?
আমার প্রিয় অবশ্যই ব্রাজিল।
আর প্রিয় ফুটবলার?
ব্রাজিলের রোনালদিনহোর অন্ধভক্ত আমি। বলের ওপর ওর নিয়ন্ত্রণ দেখে ভাবি এমনটা যদি পারতাম!ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ভক্ত।
তাহলে নিশ্চয়ই সর্বকালের সেরা হিসেবে আপনার রায় যাবে পেলের পক্ষে?
আসলে আমি পেলে কিংবা ম্যারাডোনা কারও খেলাই সরাসরি দেখতে পারিনি। ভিডিওতে যতটুকু দেখিছি তাতে আমার মনে হয় ম্যারাডোনাই এগিয়ে। ম্যারাডোনাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে খেলতে হয়েছে।

গতকাল হোটেল শেরাটনের লবিতে এভাবেই যখন গল্প জমে উঠছিল, তখনই বেলাল আরেজুর ডাক এলো। অনুশীলনে যেতে হবে। বাংলাদেশের বিপক্ষে স্বর্ণপদকের লড়াই! সেই লড়াইয়ের আগে শেষ অনুশীলন। যাওয়ার আগে ২১ বছর বয়সী এই ফুটবলার বলছিলেন, ‘আমরা ফুটবলপ্রেমী জাতি। আমি নিশ্চিত এখানে স্বর্ণপদক পেলে কিছু মানুষের মুখে হাসি ফুটবে! হাসতে যে ওরা ভুলেই গেছে!’

No comments: