Saturday, February 23, 2008

শৈশবে ফেরা...


কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বসেছিল প্রথম জাতীয় ঘুড়ি উৎসব। শৈশবে ফেরানো সেই উৎসব কাভার করতে গিয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতাই এখানে তুলে ধরার চেস্টা করেছি-


শৈশব স্মৃতি এ কারণেই মধুর, কারণ তখন কোনো শৈশব স্মৃতি ছিল না; ফেলে আসা সেসব দিনের গুরুত্বটা এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন কোনো এক দার্শনিক। সেই দুর্লভ শৈশব আবারো ফিরে আসার যখন হাতছানি, তখন সুযোগটা মিস করবো কেন? ছোট্ট জীবনের ছোট্ট ইচ্ছেগুলো অপহৃর্ণ রাখার কোনো মানে হয় না।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতে ঘুড়ি উৎসব! জাতীয় ঘুড়ি উড়ানো উৎসব। কায়সার ভাই যখন বললেন ‘যাবেন নাকি কক্সবাজার? তিনদিনের ট্যুর’তখন একটু দ্বিধা নিয়ে বলেছিলাম-‘যাবো।’
দ্বিধায় থাকার কারণ একটাই, ২৫ জানুয়ারি মানে শুক্রবার আমাদের একটি সাংবাদিক সংস্থার নির্বাচন। আমার অনেক প্রিয় মানুষ এরইমধ্যে ফোন করে 'ভালো আছো, অনেক দিন দেখা হয় না ' এই কথার ফাঁকে ভোট চাওয়ার কাজটা সেরে নিয়েছেন। অনেক দিন পর অনেকের সঙ্গে দেখা হবে সেটা ভোটের চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছিল। তাই তো এই দ্বিধা কিন্তু যখন শুনলাম, ঘুড়ি উড়ানো উৎসব, তখন মনে হলো এমন গেট টুগেদার অনেক করা যাবে, কেন জানি ভোট দেয়াটাকেও অর্থহীন মনে হতে লাগল! ভাবলাম ফিরে যাই না একটু সেই শৈশবে...
.......
মাসুদ পারভেজ আমার পুরনো সহকর্মী। ভোরের কাজের পর আমার দেশেও কিছুদিন ছিলেন। এখন কাজ করছেন বিডি নিউজে। সাম্প্রতিক সময়ে পারভেজ এমন ট্র্যাকিং মিস করেছেন, এই তথ্য নেই কারো কাছে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম রাকিবও যাবে। রাকিব আমার ভোরের কাগজের সহকর্মী, বন্ধু।
আমি অবশ্য শৈশব ফিরে পাবো বলেই রোমাঞ্চিত! মনে আছে এখনো-সেই ছোটবেলা, ঘুড়ি উড়ানো, সুতো কেটে যাওয়া; এরপর কান্নাকাটি...
হারিয়ে গেছে সব!
কে বলেছে হারিয়ে গেছে সব, শুক্রবারই তো আবার হাতে তুলে নেবো নাটাই! ঘুড়ি উড়াবো সমুদ্র সৈকতে। সব টেনশন একপাশে সরিয়ে রেখে ওই ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়াবো ইচ্ছেমত! ভোকাট্টা ঘুড়ি...
গত বছর সেন্ট মার্টিনে বেশ উপভোগ করেছিলাম। এবারো প্রতিটি সেকেন্ড উপভোগের পরিকপ্পনা নিয়েই যাচ্ছি। চাঁদের আলোয় সি-বিচে ছুটোছুটি, গলা ছেড়ে গান, সব চলবে...
.......
২৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে ফকিরেরপুল থেকে গাড়িতে উঠতে গিয়েই আবারো সেই দ্বিধা! যেভাবে বৃস্টি পড়ছে কাল পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে ঘুড়ি উড়বে তো? নাকি অসময়ের এই বৃস্টি শেষ করে দেবে সব? এমনিতে বাস জার্নি আমার খুব একটা পছন্দের নয়। কিন্তু ইন্ডিপেন্টেডের সবুজ ভাই, চ্যানেল আইয়ের পান্থ’, যুগান্তরের পারভেজ ভাই, আরটিভির শিপলু, জেমস ভাই, চ্যানেল ওয়ানের আহমেদ রাকিব, সমকালের সঞ্জয়, ফোকাস বাংলার সান্টু, মাসুদ পারভেজ আর রাকিবের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গাড়ি পৌঁছে গেল টেরই পেলাম না!
সকালে কান্তি নিয়েই পৌঁছলাম কক্সবাজারে। পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল লাবণীর ডরমেটরিতে অবশ্য বিশ্রামের সুযোগ মিললো না। সেই সকালেই শুরু হয়ে গেল ব্যস্ততা। ট্র্যাকিংয়ে গিয়ে আসলে শুয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। পবর্তারোহী ‘এক্সট্রিমিস্ট’ দল হোটেল লাবণীর ছাদ থেকে নামানো দড়ি বেয়ে উপড়ে উঠছে, এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই মনে হলো সকালের খাবার নেয়া উচিত। কেননা কিছুণ পরই তো সি-বিচে শুরু হবে সেই ঘুড়ি উৎসব!
.......
কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট ঘুড়ি উৎসবের মহৃল ভেন্যু। আমাদের একদিন আগেই কক্সবাজার হাজির হওয়া আলিম ভাইকে পেয়ে গেলাম সেখানে। ঘুড়ি উৎসবের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার বলেই একদিন আগে হাজির থাকতে হয়েছে তাকে। পরিচয় হলো রাকিবের ছোট ভাই তানভীরের সঙ্গে। পেশাগত কারণে এখন ও থাকছে সেখানে। মনে হচ্ছে গাইডের পাশাপাশি আরো অনেক সুবিধাই নেয়া যাবে তানভীরের কাছ থেকে।
কিন্তু সেসব ভাবার সময় কোথায়? আমার চোখ তখন বঙ্গোপসাগরে নয়, আকাশে। কেননা তখন নীল আকাশে খেলা করছে নানা রঙের ঘুড়ি। ঢাকায় ওইদিন ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে বৃদ্বি নেমে এলেও কক্সবাজারে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন! আমার সেই শঙ্কা উধাও!
.......
উৎসবের জন্য আয়োজকরা তৈরি করেছিলেন আড়াইশ ডিজাইনের ঘুড়ি। সেসব ঘুড়ির জন্য অভিনব নামও রেখেছিলেন। বৈচিত্র্যপহৃর্ণ নামগুলো এরকম-বেসাতি, ড্রাগন, ডেল্টা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বক্স, মাছরাঙা, তোতা পাখি, ফরিঙ, ফিঙ্গে, প্রজাপ্রতি, গোল্ডফিশ, হাঙ্গর, ইগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, মৌচাক, প্যাঁচা, মিকি মাউস কিংবা সান্তাক্লজ!
.......
শুক্রবার ছুটির দিন এমনিতেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ভিড় একটু বেশিই ছিল। কিন্তু শুধু সমুদ্র নয়, এই ঘুড়ি উৎসব ও টেনেছে সবাইকে। সবাই যেন নস্টালজিয়ায় পড়ে গেছেন! তেমনি একজন ঢাকার ইস্টাটনের জুবায়ের। ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে বলছিলেন, ‘সত্যিই আমি যেন সেই শৈশবে ফিরে গেছি। কতদিন পর যে আবার নাটাই হাতে তুলে নিলাম!’ একইভাবে অতীতে ফিরে গেলেন প্রৌঢ়ত্বে পা দেয়া ব্যববসায়ী মাসুম ইকবাল, ‘কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, আকাশের দিকে তাকাতেই ভুলে গিয়েছিলাম। আকাশের দিকে তাকালে তো মনটাও আকাশের মতো বিশাল হয়ে যায়! মনে হচ্ছে সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি আবার। এই দিনটার কথা ভুলবো না কখনো।’
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ছেয়ে গিয়েছিল রংবেংয়ের ঘুড়িতে। এমনিতে ১০৮ জন প্রতিযোগীর ঘুড়ি উড়ানোর কথা থাকলেও কক্সবাজারে আসা হাজারো পর্যটক কিছুণের জন্য হলেও হাতে তুলে নিয়েছিলেন নাটাই। এভাবেই যেন পৃর্ণতা পেয়েছে প্রথম জাতীয় ঘুড়ি উৎসব। পহৃর্ণতা পাওয়ার পেছনে যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সেই ফেডারেশন সম্পাদক শাহজাহান মৃধা বেনু বলছিলেন, ‘আমরা চেয়েছি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে! মানে বঙ্গোপসাগরের ঠিক সামনে চমৎকার পরিবেশে ঘুড়ি উড়ানো আর প্রাকৃতিক সপতাশ্চর্যের সম্ভাব্য তালিকায় এগিয়ে থাকা কক্সবাজারকে আরো বেশি আলোচনায় নিয়ে আসা। ঘুড়ি আর কক্সবাজার দুটোই এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এটা ঠিক ২৮০০ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া এই সংস্কৃতি নিয়ে আগের মতো উন্মাদনা নেই। তাই তো আমরা চেয়েছি সমুদ্রের সামনে এই উৎসবটা জমিয়ে তুলতে। যাতে ১২০ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতও উঠে আসে আলোচনায়। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান যে, সবাই সত্বম্ফূর্তভাবেই বিষয়টা নিয়েছে।’
.......
শনিবার মানে ২৬ জানুয়ারি কোনো কাজ নেই! আয়োজকরা জানিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবেন আপনারা। কিন্তু রাকিব ঠিক ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়ানোর মানুষ নয়। এখানেও নিখুঁত প্ল্যান, ‘আজকের দিনটাকে কাজে লাগাবো আমরা। প্রথমে যাবো হিমছড়ি, এরপর ইনানি বিচ।’ পরিকপ্পনা বাস্তবায়নের জন্য তানভীর তো আছেই। একটা গাড়ি ম্যানেজ করলো ও। আর তাতে চড়েই আমরা রওনা হলাম হিমছড়ি। ছোট ওই ঝরনাকে ঘিরে পর্যটকদের অনেক ভিড় থাকলেও আসলে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই! একই কথা প্রযোজ্য কক্সবাজারের ক্ষেত্রেও। আমরা শুধু সর্ববৃৎ সি-বিচের কথাই বলি, কিন্তু এটা বলি না যে এখানে কী সুযোগ-সুবিধা আছে? সময় কাটানোর জন্য আসলে তেমন কিছুই নেই। এতো বড় বিচের পুরোটাতেই পরিকল্পনার বড় অভাব।
কিন্তু ইনানিতে গিয়ে রীতিমত মুগ্ধ হলাম। নীল জল! সব যেন সাজানো গোছানো!
এমন নোনা জলের হাতছানি পাশ কাটাবো কি করে? তানভীর, আসিফুল ইসলাম সাদ, আলীম ভাই, পারভেজ, সঞ্জয়, জেমস-আমরা সবাই নেমে গেলাম পানিতে। কক্সবাজার থেকে ১৮ কিলোমিটার দুরের এতো সুন্দর সৈকত, না দেখে গেলে আফসোস থেকে যেতো!
.......
এবার ফেরার পালা! আমরা গাড়িতে উঠলাম রাত ১টায়। ঢাকার বৃষ্টি তখন কক্সবাজারেও। রেস্টুরেন্ট অ্যাঞ্জেল ড্রপ থেকে ফেরার পথে চার নম্বর বিপদ সংকেতের খবর পেলাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই চাইছিলেন দ্রুত ঢাকা ফিরতে, মধ্যরাতে চলতে শুরু করল গাড়ি। কিন্তু রাস্তার যে অবস্থা তাতে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন ড্রাইভার!
কিন্তু এনিয়ে আমাদের কোনো তাড়া ছিল না। কেননা তখন গাড়িতে আসর জমিয়ে তুলেছেন ছেলে-বুড়ো সবারই প্রিয় সেলিম ভাই! গলা ছেড়ে জিয়া, স্বপন, নওরোজদের সঙ্গে গান গাইছেন তিনিও।
এভাবেই কখন যে ঢাকায় পৌঁছে গেলাম, বুঝলামই না! ৮ ঘণ্টার পথ ১৩ ঘণ্টায় আসার পরও মনে হচ্ছিল আরেকটু দেরি হলো না কেন?
ভাবছিলাম এই তো আবার শুরু হলো নাগরিক ব্যস্ততা; বেঁচে থাকার যন্ত্রণা!