Saturday, January 30, 2010

সন্ধ্যায় রঙিন স্টেডিয়াম

চোখ ধাঁধানো, জমকালো কিংবা বাংলাদেশে এই প্রথম! এমন কথা গত কয়েকদিন ধরেই বলছিলেন এসএ গেমস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজকরা। তাদের সেই কথায় বিশ্বাস না রেখেও উপায় ছিল না। টাকা যে কথা বলে! এবারের এসএ গেমস বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানে। হিসাবটা মনে রাখুন—৪৮ কোটি টাকা! সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ‘অ্যাকুয়েটিক শো’র রঙ্গিন ছটায় যা একটু আলোক ছড়াল। কিন্তু এই মিনিট পনের বর্ণিল আলোকরশ্মির আলোকমালা ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বাকি পর্বগুলোতে নতুনত্ব ছিল কোথায়?
গতকাল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রায় তিনঘণ্টা স্থায়ী সেই ১১তম এসএ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকাল সোয়া ৪টায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্টেডিয়ামের দুই নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আফগানিস্তানের অ্যাথলিটদের দিয়ে শুরু হয় মার্চপাস্ট। এরপর ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী মার্চপাস্টে অংশ নেয় অন্য ৭ দেশ। মার্চপাস্টে ৪৫৩ সদস্যের বাংলাদেশ দলের পতাকা ছিল কমনওয়েথ গেমসে স্বর্ণপদক জেতা শুটার আসিফের হাতে। এরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহত্ ক্রীড়া আসর ১১তম এসএ গেমসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আকাশ ছেয়ে যায় শান্তির প্রতীক কবুতর এবং বেলুনে।সাবেক ১১ কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদের হাতঘুরে শেষ পর্যন্ত মশাল আসে আরেক কিংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিনের হাতে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি ও সাবেক এই ফুটবলার জ্বেলে দেন ১০০ ফুট উপরে স্থাপিত গেমস মশাল।
এরপর ক্রীড়াবিদদের শপথ!মোবাইল কারাভ্যান দিয়ে তারপরই মাঠে আসেন দেশের তিন জনপ্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমীন এবং শুভ্র দেব। গানে গানে তারা স্বাগত জানান সবাইকে। গেমসের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দু’এক কথা বলার পরই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চারটি লাইন আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের গান অঞ্জলি লহমোরের সঙ্গে নেচে ওঠেন একঝাঁক নৃত্যশিল্পী। যার নেতৃত্বে ছিলেন দেশসেরা দুই নৃত্যশিল্পী শিবলী মুহাম্মদ এবং শামীম আরা নীপা। এমন আয়োজন ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের অংশগ্রহণ ছাড়া চিন্তা করা যায় না। এবার ঠিক প্রজাপতির সাজে তারা হাজির হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেই চেনা গান ‘প্রজাপ্রতি প্রজাপ্রতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা..!’
রঙিন সাজ পোশাকে আসা সেই পারফরমারদের মনে হচ্ছিল বুঝি সত্যি সত্যিই উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়! এই পারফরম্যান্সের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই মাঠে আসে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ছেলেরা। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’—এই গানের সঙ্গে তারা ফুটিয়ে তোলে স্বাধীনতার নানা রূপকচিত্র। সঙ্গে গ্যালারির একপাশে ঢাকা ইডেন কলেজের মেয়েদের ক্যালিসথালিক শো চলেছে! সেখানে অবশ্য রাজনীতিকে দূরে রাখা হয়নি। কারণে অকারণে বেশ কয়েকবারই ভেসে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি! জাগ্রত বাংলাদেশ পর্বের এক পর্যায়ে বাংলার ঐতিহ্যের অংশ ঢোল নিয়ে নামে পারফরমাররা। চলে নাও ছাইড়া দে পাল ওড়াইয়া দে’র সঙ্গে মিক্সড তাকধুম তাকধুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল! সঙ্গীত আর নাচে মনে হচ্ছিল পদ্মার ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে মাঠে!সাঁওতাল বিদ্রোহের গৌরব ইতিহাস ইলা মিত্রের ‘নাচোলের রানী’র গীতিকাব্য পরিবেশনাও ছিল অনুষ্ঠানের কিছু অংশজুড়ে। এখানে ৬০০ সাঁওতাল শিল্পী অংশ নেন।
এমন চেনা ও এর আগে অনেকবার দেখা পর্বগুলো শেষ হতেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের রাতের আকাশ রঙ্গিন হয়ে ওঠে। শুরু হয় অ্যাকুয়েটিক শো। যেখানে লেজার শো’র সঙ্গে জলের বুকে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষদের পাশে দাঁড়ানো বিটলস গায়ক জর্জ হ্যারিসন, ৭ মার্চের ভাষণ সেখানে উঠে এলেও দেশের অনেক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ছিলেন তাদের এই পাণ্ডুলিপির বাইরে!
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সেই প্রত্যাশার বেলুন চুপসে যাওয়ার পর এবার পদকের লড়াই! বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা ১৭টি সোনার পদকের লক্ষ্য নিয়ে আজ থেকেই নেমে পড়বে মাঠ, ট্র্যাক, সুইমিং পুল, কোর্ট আর শুটিং রেঞ্জে। সময় এখন দেখার আমাদের ‘অলিম্পিক’ গেমস কতটা আমাদের হয়ে ওঠে!

Friday, January 29, 2010

আমাদের অলিম্পিক গেমস

কথায় আছে, যায় দিন ভালো যায়! বহুল প্রচলিত এ কথার যৌক্তিকতা বারবার প্রমাণিত হয়েছে আমাদের যাপিত জীবনে। আজ থেকে ঢাকাসহ ৫টি বিভাগীয় শহরে শুরু হচ্ছে এ অঞ্চলের ‘অলিম্পিক গেমস’ বলে পরিচিত এসএ গেমস! অথচ একদিন আগেও খেলার পাতার প্রায় পুরোটাজুড়েই ছিল ক্রিকেট। এর আগে যে দুবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহত্ ক্রীড়া আসর, তখন এমনটা চোখে পড়েনি। ১৯৮৫ ও ১৯৯৩ সালের সে আসর ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে উন্মাদনা ছড়িয়েছিল শুরু হওয়ার মাসখানেক আগেই। দিন গণনায় ব্যস্ত থেকেছে মিডিয়াগুলো! সবাই প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছে কখন শুরু হবে গেমস!
আজ অন্যরকম এক আবহের মধ্য দিয়েই শুরু হচ্ছে এসএ গেমসের ১১তম আসর। যেখানে ক্রীড়াপ্রেমীদের আগ্রহের পারদ নিচেই থাকছে। কিন্তু এরই মধ্যে এ গেমসে অংশ নিতে ঢাকায় চলে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার অপর সাত দেশ আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা। স্বাগতিক বাংলাদেশের অ্যাথলিটরাও ট্র্যাকে কিংবা মাঠে নামার অপেক্ষায়। ২৩টি ডিসিপ্লিনে ১৫৮টি স্বর্ণ পদকের জন্য লড়বেন ২ হাজারেরও বেশি প্রতিযোগী! গতকাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ টাওয়ারে সংবাদমাধ্যমকে যখন এ তথ্য দিচ্ছিলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার তখনও এসএ গেমসের ক্রীড়া স্থাপনাগুলোতে চলছিল হাতুড়ি-বাটালের ঠোকাঠুকির শব্দ!
১৭০ কোটি টাকা বাজেটের এ আসর উদ্বোধনের ২৪ ঘণ্টা আগেও শেষ হয়নি অনেক ভেন্যুর নির্মাণ এবং সংস্কার কাজ। তার চেয়েও বড় কথা গেমস ঘিরে যেমন স্পোর্টস ভিলেজ তৈরি করা হয় এখানে তেমনটা নেই। অনেকটা হযবরল অবস্থার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে সবকিছু! যদিও আয়োজক বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ গতকাল বলছিলেন, ‘এটার সঙ্গে অন্যসব ক্রীড়া আসরকে মেলানো ঠিক হবে না। এটা অলিম্পিক কিংবা কমনওয়েলথ গেমস নয়। আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে ভালো করার চেষ্টা করেছি। আর আপনাদের এটা জানিয়ে রাখছি আয়োজন সবাইকে মুগ্ধ করবেই।’সেই মুগ্ধতা আজ থেকেই শুরু হবে! চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আজ বিকাল সোয়া ৪টায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এ আসরের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপরই থাকছে চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মনোমুগ্ধকর হতে তো বাধ্য। উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠানের পেছনেই যে খরচ হচ্ছে ৪৮ কোটি টাকা! দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি ১৩৩ মিনিটের তিন পর্বের এ অনুষ্ঠানে থাকবে অ্যাকুয়েটিক শো! ফ্রান্স থেকে এরই মধ্যে আনা হয়েছে ১৮ বাই ৪০০ ফুটের পুল! যেখানে জলের ঝড় তুলে সবাইকে মুগ্ধ করার প্রতীক্ষায় পারফরমাররা। মোট ২২ হাজার পারফরমার যুক্ত হচ্ছেন এ আয়োজনে।উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠানই কিন্তু গেমস নয়। মাঝের ১০ দিনই হবে সত্যিকারের গেমস। পদক জয়ের জন্য অ্যাথলিটরা গতির ঝড় তোলার চেষ্টায় থাকবেন ট্র্যাকে। জলের বুকে ঝড় তুলবেন সাঁতারুরা। শুটাররা খুঁজবেন সঠিক নিশানা! আর এখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা স্বর্ণের দেখা পেলেই এদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে সত্যিকার অর্থে জমে উঠবে গেমস। এবারের এসএ গেমসে ১৭টি সোনার পদক জয়ের প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে অনেক ডিসিপ্লিনের অ্যাথলিটরা অনুশীলন শুরু করলেও অনেকের মনে আছে আক্ষেপ। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে অনেক অ্যাথলিটের প্রস্তুতির ঘাটতিও থাকছে!
রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি অন্য ৪ বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা এবং সিলেট প্রস্তুত। আজ থেকে ক’দিন হয়তো সবার জীবনযাত্রায় যোগ হবে নতুন এ অধ্যায় এসএ গেমস। স্টেডিয়ামমুখী যারা হতে পারবেন না তাদের জন্য থাকবে টেলিভিশনে সরাসরি ২৩ ডিসিপ্লিনের পদক জয়ের লড়াই দেখার সুযোগ। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে বসানো হবে ১৭টি জায়ান্ট স্কিন!এরই মধ্যে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লেগে থাকা ব্যানার-ফেস্টুনের সংখ্যা বেড়েছে! জাতীয় পাখি দোয়েলের নতুন নতুন সাজ চোখে পড়ছে সবার।
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন কাল নিশ্চিত করেছে স্পোর্টস ভিলেজ না করতে পারলেও পুরো বাংলাদেশই সাজবে নতুন সাজে! হাজারো সমস্যা ঘিরে থাকা দেশের ১৫ কোটি মানুষ কিছুদিন অন্তত উত্সবের অনুষঙ্গ পাবে। প্রত্যেক ক্রীড়াবিদের জন্য দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরার এইতো সুযোগ!