Sunday, January 1, 2023

all your dreams come true

প্রতিটা মাসের মাঝামাঝিতে মনে হয় মাস ফুরাচ্ছে না, দিন গুনতে থাকি...! কিন্তু কী আশ্চর্য, চোখের পলকে ফুরিয়ে যায় একেকটা বছর। বয়স বাড়তে থাকে সবার। ২০২২-এর শুরু এইতো সেদিন, কিন্তু নিমেষে বছরটা হাওয়া!

২০২২ নানা কারণে মনে থাকবে। পরিবারের কয়েকজনের অসুস্থতা ছাড়া বছরটা মনের মতো কেটেছে। জীবনের উত্থান-পতন, ঠেকে শেখা, মানিয়ে নেওয়া এসব গল্প তো ছিলই, সঙ্গে অসাধারণ কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি সদ্য শেষ বছরে। অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছি, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা...
২০২৩, এই বছরটা আরও চ্যালেঞ্জের। টিকে থাকাটা আরও বেশি করে রপ্ত করতে হবে। একটু ধৈর্য আর বিশ্বাস নিয়ে প্রতীক্ষায়... প্রতীক্ষার মূল্য নিশ্চয়ই আসবেই, সবার জীবনে!
বছরটা শুভ হোক প্রত্যেকের!
Happy New Year... I hope all your dreams come true in 2023. Onwards and upwards!

‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর...’



 ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর...’

শৈশবের স্মৃতিগুলো কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া পথেরই মতো অস্পষ্ট যাচ্ছে, একটু একটু করে! একটা সময় চোখ বন্ধ করে একটু ভাবনার অতলে ডুবলেই নিমিষে খুঁজে পেতাম সেই সব সময়... অফুরন্ত একেকটা আনন্দমাখা দিন।
আমাদের সেই ধুলো উড়া পথ, তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট একটা বিল... প্রাণের সুতার লহরি। বর্ষায় থৈথৈ পানি আর শীতে কচুরিপানায় আড়াল হয়ে থাকতো ছোট-বড় খাঁদ। পানি কমতে থাকলে তারপর একটা সময় পরীক্ষা শেষে স্কুল ছুটি হলেই সেই খাঁদ সেচে চলতো দিনভর মাছ ধরা! আহা, মিষ্টি মধুর স্মৃতির দলের মতো ঝাকে ঝাকে কতো মাছ, পুটি, শিং, মাগুর, কৈ...ছোট্ট একটা জায়গায় কতোশত মাছ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও মাছ ধরা শেষ করতে পারতাম না কিছুতেই।
আমাদের বাকি বিকেলগুলো চলতো ধুলো উড়িয়ে ফুটবল কিংবা ব্যাট-বলের লড়াইয়ে। শীতের শেষ বিকেলে র‌্যাকেট-ফ্লাওয়ারে ঘাম ঝরানো ছাড়াও অলস কিছুদিন ছিল আমাদের। যে দিনগুলোতে পুরো পশ্চিম পাড়া দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতাম আমরা। এখানে সেখানে পেয়াদা বাড়ি, তেতুল তলা, এই বাড়ি সেই বাড়ি...!
গন্ডারদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমাদের পুরোনো সেই স্কুল ঘরটা এখনো চোখে ভাসে। মনে হয় এইতো সেদিন ভাঙ্গা জীর্ণ হয়ে আসা মরিচা পড়া টিনের দোচালা সেই স্কুলের বেঞ্চে বসে আছি। নারান্দীর হেড স্যার কড়া চোখে তাকাচ্ছেন। ব্ল্যাক বোর্ডে নজর নেই বলে বেত নিয়ে মারবেন বলেও মারছেন না। মমতাজ উদ্দিন স্যারের ঘুম ঝরানো কণ্ঠটা ভাসে! স্কুলের ছোট্ট মাঠটার পাশে মেম্বার দাদার দোকান। পুরো গ্রাম জুড়ে তখন একটাই মুদির দোকান, চাল-ডাল, তেল-সাবান, ডাক্তারি পথ্য এমন কী কাফনের কাপড়ও! দুপুরে নিস্তরঙ্গ সময়টাতে দাদা দোকানের মধ্যেই নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়তেন, কেউ অপেক্ষা করতেন কখন ঘুম ভাঙবে। আবার কেউ হয়তো ডেকে তুলে এক পোয়া কেরাসিন তেল নিয়ে যেতেন সন্ধ্যার হারিকেন জ্বালাবেন বলে।
স্কুল ছুটি হলে আমরা এদিক-সেদিক তাকাতাম না। সোজা এক দৌড়ে মাটির রাস্তা ধরে ঘরের পথে। বাড়ি ভর্তি আনন্দ আমাদের, সরকার বাড়ি। মানুষে প্রতিটা ঘর কী যে সরগরম থাকতো। পড়াশোনার সঙ্গে খেলাধূলা.. এটা সেটা পিকনিক, তারমধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতাও থাকতো সব সময়। সবার ঘরে একটা করে পাঠাগার, বই পড়ার প্রতিযোগিতা, পড়াশোনায় এগিয়ে যাওয়ার একটা লড়াই!
এরমধ্যে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট এলো আমাদের গ্রামে। দিন তারিখ মনে নেই-হতে পারে ৮৮ থেকে ৯০! আসলেই স্মৃতির পথগুলো শীতের কুয়াশার আড়ালে চলে যাচ্ছে বড্ড অস্থির হয়ে দ্রুত! কিন্তু সেই একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট ভুলতে পারবো না একেবারে অশীতিপর হয়ে চলে গেলেও।
আমাদের পুরো গ্রাম একদিকে আর সরকার বাড়ি অন্যদিকে। কী যে এক উন্মাদনা! ঠিক তখনই আমাদের সামনে এলেন এক নায়ক। তিনি আমার চোখে এখনও নায়ক। ছোট্ট গড়নের, পেটানো শরীর। আহা, এই মানুষটার পায়েই কী যে যাদু। আমরা তখন ডিয়েগো ম্যারাডোনার মুগ্ধতা সবে হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি, ঠিক তখনই আমাদের সামনেই আরেক ফুটবল জাদুকর। শুধু কী পা, মাথাতেও সমান দক্ষতা। বুলেট গতির শটের সঙ্গে দারুণ সব হেড! তার সেই ম্যাজিকই আমাদের এক সুতোয় গেঁথে দিল। সেই প্রথম আমাদের সরকার বাড়িটাকে সবাই ধারণ করতে শুরু করলাম...মন প্রাণ দিয়ে! এই বাড়ি কতো প্রতিভার জন্ম দিলেও তিনিই হয়ে থাকলেন প্রথম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর!
মাঠের সেই মানুষটি আঘাতে লুটিয়ে পড়লে আমরাও ভেঙে পড়ি। তিনি নিশানা খুঁজে পেয়ে হেসে উঠলে আমরাও হাসি। তার একটা বাই-সাইকেল কিক দেখার জন্য সাইড লাইনের বাইরে অধীর হয়ে থাকি মিনিটের পর মিনিট। এখনো কান পাতলে সেই হাসি সেই সময়টা অস্থির সেতারের শব্দের মতো আকুল হয়ে এসে ধরা দেয়। আমি ভুলতে পারি না সেই সব মুখ, সেইসব মানুষ যারা আমার শৈশব রাঙিয়ে তুলেছিলেন। যারা ছিলেন বলেই বারবার ব্যাকুল হয়ে উঠে আমার মন, সব অর্জনের বিনিময়ে হলেও ফিরে যেতে চায় একটি দিনের জন্য সেই সব ধুলো উড়া বিকেলে.. প্রচন্ড বৃষ্টিতে বিলের মাঝখানটায়, জাদুবাস্তবতাবাদ! তেমন একটা অলস দুপুর আর আসে না।
মানুষ কোথায় হারিয়ে যায়? আমাদের শৈশব স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে ভাইজান চলে গেছেন অনেক আগেই। দিন-তারিখ কিচ্ছু মনে রাখতে চাইনি বলে মনেও নেই তিনি হারিয়ে গেছেন নিঃস্ব করে আমাদের। আলম কাকাও হঠাৎ একদিন না বলে আমাদের শৈশব স্মৃতিটুকু সঙ্গে নিয়ে উধাও!
এবার সেই নায়কটিও আর নেই। দর্পন কাকা, সেই আমাদের ছোট্ট বেলার ম্যারাডোনা। তিনি আমাদের-এটা বলতে পারলেই গর্বে উঁচু হয়ে উঠতো মাথা। যিনি ফুটবল পায়ে লিখতেন রূপকথা। বল নিয়ে কারিকুরিতে মনে করিয়ে দিতেন ফুটবল নিছক খেলা নয়, কবিতা, গল্প-উপন্যাস সবই। যার হাত-চোখে এমনই নিশানা যে ছোট্ট একটা এয়ারগানে গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শিকারও নিমিষে নেমে আসতো মাটিতে!
আহারে সময়, কিছুতেই লেখার ফ্রেমে আটকাতে পারছি না মূহুর্তগুলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে স্মৃতিরা সব চিৎকার করেছে কিন্তু কারও কথা কোন ঘটনাই ঠিকঠাক বলে উঠতে পারছি না। আবেগ থেকে বেরোতে না পারলে আসলে নির্মোহ সেই গল্পেরা ওঠে আসে না, কথায় গল্পে। এলোমেলো অসম্পূর্ণ এইসব কথার মানেটা অন্যদের কাছে হয়তো দুর্বোধ্য-অগভীর। আমাদের কাছেই তা অপরিমেয়!
দর্পন কাকাকে কবর দিয়ে শহরের পথে ফিরতে ফিরতে কথাগুলো ভাবছিলাম। কুয়েতে নিমর্ম প্রবাস জীবন শেষে উনার নিথর দেহটা কফিনে বন্ধী হয়ে এসেছিল একদিন আগেই! বাড়ি ফিরে এবার তিনি চিরদিনের জন্য নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়েছেন।
আমি তখন মনোহরদী থেকে ঢাকার পথে। বাইরে অন্ধকার। আমার ভেতরটা গভীর অন্ধকার! একরাশ দীর্ঘশ্বাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাথায় সব স্মৃতির দল যেন ঝাঁকের ইলিশের মতো ঘুরছে, এই আলো-আঁধারিতে! মানুষ বড্ড অসহায়, কিছুই তার হাতে নেই। না, জানি কিসের আশায়, ক্ষাণিক ভাল থাকার প্রলোভনে অন্তবিহীন পথে শুধু ছুটে চলা, তারপর এভাবেই একদিন ধপ করে নিভে যায় ধুপছায়া!
ভাগ্য সঙ্গে নিয়ে আসা কেউ গোধূলী বেলায় পড়ন্ত দিনের দেখা পায়; কেউ আবার মধ্য দুপুরে মাঝ পথেই পথ হারিয়ে কী জানি কোন অভিমানে হাঁটা দেন অসীমের পানে...! আহারে মানব জনম, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর...’