Sunday, February 7, 2010

স্বর্ণকন্যা রুমির সংগ্রামী জীবন

গল্পটা ঠিক আর দশটি পরিবারের মতো নয়! সেটা হলে তো আট ভাইবোনের সবচেয়ে ছোটটি সেই পঞ্চগড়ের আজিজনগরেই থাকত! আবদার আর আদরেই কাটত শৈশবের দিনগুলো। কিন্তু বেশি ভাইবোন থাকা পরিবারের আদুরে বোন হওয়া সম্ভব হয়নি শারমিন ফারজানা রুমির। জীবনের কঠিন বাস্তবতা যতটুকু থাকে, তারচেয়েও বেশি অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে। তাইতো ‘না’ শব্দের অস্তিত্ব নেই তার অভিধানে! গতকাল সেই সংগ্রামের পুরস্কারও মিলল!
আফগানিস্তানের লায়লা হোসাঙ্গের হিসাব উল্টে দিয়ে তায়কোয়ান্দোর অনূর্ধ্ব-৪৬ কেজিতে স্বর্ণপদক জিতলেন বাংলাদেশের শারমিন ফারজানা রুমি। এবারের এসএ গেমসে হামিদুলের পর আবারও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) জিমন্যাসিয়ামে বেজে উঠল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। উড়ল লাল-সবুজ পতাকা।
হিসাবের ছকে এ ইভেন্টে আফগানিস্তানের প্রতিযোগীই ছিল ফেভারিট। কিন্তু দিনটা ছিল বাংলাদেশের রুমির। নেপালের ইয়ান কুমারীকে হারানোর পরই বুঝতে পারেন আজ হবে! ‘মিথ্যে বলব না। আমার লক্ষ্য ছিল ভালো খেলা। কোনো পদক আসবে—এসব নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু নেপালের প্রতিযোগীকে শুরুতেই যেভাবে হারালাম, তারপর মনে হলো আজ হবে’—বলছিলেন রুমি। আসলেই হলো। এরপর গতকাল বিকালে এনএসসি জিমন্যাসিয়ামে যা করতে চেয়েছেন, তাই হয়েছে। ৩ রাউন্ডের লড়াইয়ে আফগানিস্তানের লায়লার বিপক্ষে জিতেছেন ১৫-৪ পয়েন্টে। তবে যতটা সহজে বলা হয়ে গেল ১৫-৪ পয়েন্টে জিতেছেন, ঠিক ততটা সহজ ছিল না লড়াইটি। মার্শাল আর্টের খেলায় কাল দুপুর থেকেই অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাকে। এরপরই মিলেছে স্বর্ণপদক। আসলে একদিনের পরিশ্রমেই কি ওই স্বর্ণ বাস্তবের ছোঁয়া পেল? না, বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার আজিজনগর গ্রামে জন্ম নেয়া মেয়েটির এই স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে। তখন শারমিন ফারজানা রুমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। পড়ছে স্থানীয় কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তখনই বাংলাদেশ আনসারের প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির কর্মকর্তাদের নজরে পড়ে রুমি। কিন্তু পরিবারের অনুমতি তখনও বাকি। রুমির বয়স যখন ৬, তখনই বাবা মারা যান। ৮ ভাইবোনের সেই সংসারের কর্তা তখন বড় ভাই। একজনের সংস্থান হলে সংসারের খরচ কমবে—এই ভেবে বড় ভাই অনুমতি দিয়ে দেন। শুরু হয় রুমির নতুন সংগ্রাম। পড়াশোনা এবং আনসারের হয়ে তায়কোয়ান্দো চর্চা।
প্রতিদিন ৫ ঘণ্টার বেশি অনুশীলন; এরপর পড়াশোনা—সব মিলিয়ে তার অন্যসব সতীর্থ যখন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে কিংবা পালানোর পরিকল্পনা করছে, তখন রুমি ছিলেন অন্যরকম। আসলে তা না থেকেও উপায় ছিল না। তাকে যে মানিয়ে নিতেই হবে। তাতে অন্তত সংসারে কিছুটা হলেও যে চাপ কমে! এভাবেই একসময় পাস করেন এসএসসি। আর তাতে পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে থাকে।এসএ গেমসের জন্য অনুশীলন করেছেন গত ১৪ মাস ধরে। চাইনিজ কোচ লি জু চাংয়ের প্রিয় ছাত্রীদের একজন হয়ে ওঠেন রুমি। কেননা, অন্যরা অনুশীলনে ফাঁকি দিলেও রুমি সময় দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। যেমনটা বলছিলেন—‘আসলে কখনই আমি ফাঁকি দেয়ার পক্ষপাতী ছিলাম না। কেননা এটা তো নিজেকে নিজেই ফাঁকি দেয়া! এগিয়ে যেতে হলে আমাকে তো পরিশ্রম করতেই হবে।’ পরিশ্রমের এই স্বীকৃতির পর ২০ বছর বয়সী রুমি বলছিলেন—‘এখানেই থেমে যেতে চাই না আমি। আমার লক্ষ্য থাকবে এখন এশিয়ান অন্য গেমসগুলো। সেখানেও ভালো করতে চাই।’এটা তো গেল দেশের জন্য কিছু করার কথা। স্বর্ণ এনে দেয়ার পর নিজেকে নিয়ে কি ভাবছেন তিনি?
না, এখানেও ব্যতিক্রম তেঁতুলিয়ার এই তরুণী। অন্যরা যখন সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলেন, সেখানে আনসার থেকে মাসে চার হাজার টাকা বেতন পাওয়া শারমিন ফারজানা রুমি বলছিলেন—‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। অনেক কিছু পাচ্ছি। শুধু আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।’কিছু মানুষ আছেন যারা নীরবে শুধু দিয়ে যেতেই জানেন। স্বর্ণকন্যা রুমি সেই তাদেরই একজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—প্রতিভার মূল্যায়ন না হলে তা আর কতদিন টেকে?

No comments: