যুদ্ধের মধ্যেই বেড়ে ওঠা আফগানিস্তানের এই প্রজন্ম সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছে! তাইতো এবারের এসএ গেমসে ৭৭ কেজি ভারোত্তোলনে ব্রোঞ্জজয়ী আফগান নাগরিক মোস্তফা কারমান্দ বলছিলেন, ‘এখন প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে আমাদের দেশের চেহারা। যুদ্ধ শেষ। আমরা ফুটবল খেলার মাঠ কিংবা ভারোত্তোলনের জিমন্যাসিয়াম সবকিছু আবার বুঝে পেয়েছি। শুধু কাবুল নয়, এখন পুরো দেশ থেকেই ক্রীড়াবিদরা উঠে আসছেন।’ যদিও এই মোস্তফা কারমান্দের চলার পথে আর দশজন আফগানের মতো কাঁটা বিছানো ছিল না। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের ধনী এক পরিবারে জন্ম তার। বাবা রহমুতুল্লাহ কারমান্দও একসময় ভারোত্তোলক ছিলেন। অলিম্পিক গেমসে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশের। এখন আফগান ওয়েটলিফটিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। বাবাকে দেখেই ভারোত্তোলনে নাম লেখান মোস্তফা। অবশ্য তাদের পরিবারের অন্য দু’ভাইও ভারোত্তোলক। যার মধ্যে একজন এখন খেলা ছেড়ে কাজ করছেন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অন্যজন পাড়ি জমিয়েছেন মার্কিন মুল্লুকে।
কিন্তু মোস্তফা কারমান্দের অন্য দেশে পাড়ি জমানোর ইচ্ছে নেই। খেলাধুলার বাইরে পড়াশোনা নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হয় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার এন্ড সায়েন্সে পড়া এই তরুণকে। জানালেন, লক্ষ্য আছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ভারোত্তোলক হওয়ার—‘দেখুন আমি কি করতে পারবো সেটা না ভেবে পরিশ্রম করে যেতে চাই। যদি লক্ষ্যের কথা বলেন তবে বলব, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হতে চাই আমি। এরপর যখন বয়সে কুলোবে না তখন দেশের সেবা করতে চাই।’
২০ বছর বয়সী এই তরুণের মতো এতোটা ভাগ্যবান নন এসএ গেমসে আফগান দলের আরেক ভারোত্তোলক মারওয়ান বিমার। তার জন্ম এমন এক জায়গায় যার নাম শুনলে ওসামা বিন লাদেনের কথা মনে পড়ে সবার। একসময়ের তালেবান নিয়ন্ত্রিত কান্দাহারে জন্ম মারওয়ান বিমারের। তিনি বলেন, এখন আসলেই পাল্টে যাচ্ছে আফগানিস্তানের চেহারা। এটি আর মৃত্যুপুরী নেই—‘মিথ্যে বলছি না, আমরা আফগানিস্তানে সত্যিই ভালো আছি। আবার শান্তি ফিরে এসেছে আমাদের দেশে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর আমাদের এই প্রজন্ম ক্রীড়ামুখী হয়ে উঠেছে। আসলে টেলিভিশনে অনেক কিছু দেখে আমাদের দেশ সম্পর্কে বাইরের বিশ্ব কিছুই বুঝতে পারছে না। ভুল তথ্য যাচ্ছে সবার কাছে। দেখুন, গত বছর বডি বিল্ডিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে হেলমন্দ নামের এক অচেনা এলাকার বাসিন্দা। গ্রামের মানুষও সব ভুলে মাঠে ফিরছে!’ তিন আরও জানালেন, দেশটিতে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা রেসলিং, সঙ্গে তায়কোয়ান্দো, ফুটবল, জুডো, ভারোত্তোলন; বাস্কেটবলেও আগ্রহ বাড়ছে। তবে এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো তারা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তি হবে—এমন দাবি মারওয়ান বিমারের।
ভবিষ্যতে কি হবে সেটা বলার সাধ্য অবশ্য কারো নেই। সেটা যাই হোক, যুদ্ধ কাটিয়ে দেশে শান্তিতো ফিরেছে, তাতেই খুশি আফগান ক্রীড়াদিরা। দলের ভারোত্তোলন কোচ মোহাম্মেদ আজম বলছিলেন, ‘আমার এই জীবনে অনেক কিছুই দেখেছি। এতো ভালো পরিবেশ আফগানিস্তানে আর আসেনি। বেশ শান্তিতে আছি! আপনাদেরকে বলছি—আমাদের দেশে এসে দেখুন, দেশটা কতো সুন্দর। আমি নিশ্চিত, মানুষগুলোর আতিথেয়তা মুগ্ধ করবে আপনাদের।’ এখানেই থামলেন না ষাটোর্ধ্ব এই কোচ। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি আমার দেশ নিয়ে সত্যিই অনেক গর্বিত! অনেক প্রলোভন এসেছিল দেশ ছেড়ে পালানোর। কিন্তু পালাইনি। এটাই পৃথিবীর সেরা দেশ, এটা ছেড়ে যাব কোথায়? এখানেই জন্ম আর এই দেশেই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকতে চাই।’
এমন দেশপ্রেম যারা ধারণ করেন তারাই আসলে পারেন ফিনিক্স পাখির মতো ধংসস্তূপ থেকে জেগে উঠতে!
No comments:
Post a Comment