এটা বাংলাদেশের জন্য যেমন এবারের গেমসে প্রথম স্বর্ণ তেমনি হামিদুলের এসএ গেমস ক্যারিয়ারেও প্রথম স্বর্ণ। এর আগে ইসলামাবাদ গেমসে রৌপ্য এবং কলম্বোতে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ। তখন অবশ্য তার ইভেন্টেও ছিল ভিন্ন। ৬২ কেজি ইভেন্টে লড়েছেন। কিন্তু এবার ওজন বাড়িয়ে ৭৭ কেজিতে নাম লেখান হামিদুল। তাতেই বাজিমাত! এই স্বর্ণপদক জেতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাবেন ৫ লাখ টাকা।গতকাল স্ন্যাচ রাউন্ডে তোলেন হামিদুল তোলেন সর্বোচ্চ ১১৭ কেজি। এখানে অবশ্য এগিয়েছিলেন বাংলাদেশের আরেক প্রতিযোগী মনোরঞ্জন রায়। ১২০ কেজি তুলে হামিদুলের চেয়ে এগিয়ে যান তিনি।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের মোহাম্মদ মোস্তফা কামান্দ পিছিয়ে ছিলেন বেশ খানিকটা। ৯০ কেজি তুলেই হাঁপিয়ে যান যুদ্ধবিধস্ত দেশটির ভারোত্তোলক। ব্রোঞ্জেই সন্তুষ্ট তিনি। ক্লিন ও জার্ক পর্বে এমনিতেই সেরা হামিদুল। মনে হচ্ছিল এখানে তার কাছে পাত্তা পাবেন না অন্য দুই প্রতিযোগী। আফগান তরুণ ১১০ কেজি তুলে থেমে গেলেও বেশ জমে ওঠে হামিদুল এবং মনোরঞ্জনের লড়াই। দুজন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল বুঝি সাফ রেকর্ড না আবার হয়ে যায়। কিন্তু এখানে স্ন্যাচ রাউন্ডের ব্যবধানটুকু কমিয়ে আনেন হামিদুল। তিনি তোলেন ১৪০ কেজি। মনোরঞ্জন থামেন ১৩৫-এ। দুই রাউন্ডে ২৫৭ কেজি তুলে দেশকে এবারের গেমসের প্রথম স্বর্ণপদক এনে দেন হামিদুল। রৌপ্য জিতেন মনোরঞ্জন।
যদিও সেনাবাহিনীর এই সদস্য বলছিলেন ২৫৭ কেজি টপকে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার। কিন্তু তাকে সেই চ্যালেঞ্জ কাজে লাগাতে দেয়া হয়নি।প্রতিযোগিতায় ভারত-পাকিস্তানের ভারোত্তোলক ছিলেন না, তাতে স্বর্ণ জেতার কাজটা একটু সহজ হয়েছে হামিদুলের। কিন্তু পদকের আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। তাইতো সেনাবাহিনীর সিএমটিটি শাখায় কর্মরত হামিদুল বলছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া! এমন একটি দিনের জন্যই আমি অপেক্ষা করেছি। সেই ১৯৯২ সালে ভারোত্তোলন শুরু করেছিলাম। অবশেষে স্বর্ণপদকের দেখা পেলাম। বলতে দ্বিধা নেই এটাই আমার ক্যারিয়ারের সেরা দিন!’ হামিদুলের এমন সাফল্যে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। সাফে পদক ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে সেই ১৯৯৪ সাল থেকে এখন অবধি তিনিই ভারোত্তোলনের সেরা তারকা! তার হাত দিয়েই এবার স্বর্ণপদক এলো। এমন দিনে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলেন হামিদুল। ফিরে গেলেন সেই শৈশবে। জানালেন ফুটবল, ক্রিকেট, হকির মতো এতো খেলা থাকতে কেন ভারোত্তোলনে নাম লেখালেন, ‘আসলে ছোটবেলায় অন্য সবার মতো আমারও প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। কিন্তু আমাদের কুষ্টিয়ার গাংনির মোয়াজ্জেম ভাই আমার চিন্তা বদলে দিলেন। তিনি কিছুটা জোর করেই আমাকে ভর্তি করালেন তার জিমন্যাস্টিকস ক্লাবে। বললেন আমার মধ্যে নাকি ভারোত্তোলকের চেহারা দেখছেন। সেদিন হেসেছিলাম...। আজ মোয়াজ্জেম ভাইয়ের কথা অনেক মনে পড়ছে!’
এমনিতে হামিদুলকে অনুসরণ করে তার অন্য দুই ভাই একরামুল এবং আশরাফুলও ভারোত্তোলনে নাম লিখিয়েছেন। এরই মধ্যে এই গেমসে তার ছোটভাই একরামুল জিতেছেন রৌপ্যপদক। সব মিলিয়ে এখন সুখী মানুষদের একজনই হওয়ার কথা হামিদুলের। কিন্তু সামনের অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ এই সুখী সময়েও তাকে চিন্তিত করে তুলছে, ‘দেখুন এখন হয়তো সংবর্ধনা পাব। কিছু টাকাও পাব। কিন্তু সময় ফুরালে সবাই ভুলে যাবে। অতীতে আমি এমনটাই দেখেছি। ভারোত্তোলনকে ক্রীড়াঙ্গনের বেশিরভাগই মানুষই গুরুত্ব দেয় না। সত্ভাইয়ের মতো মনে করে। হয়তো কিছুদিন পরই আমরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ব।’ এই আশঙ্কা সত্য হলে আসলেই অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে দেশকে স্বর্ণপদক এনে দেয়া এই ক্রীড়াবিদের জন্য, ‘আমার জীবনে সঞ্চয় বলে কিছু নেই। যা উপার্জন করি তার পুরোটাই এই শরীরের পেছনে ব্যয় করতে হয়। জানেন তো আমাদের অনেক নিয়ম মেনে পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। সেসব জোগাড়ে যা উপার্জন করি তার পুরোটাই ব্যয় হয়ে যায়। প্রতিদিন এখন আমাদের দেয়া হয় ৩৭০ টাকা। আগে পেতাম মাত্র ১২০ টাকা! টাকার অংক দেখেই বুঝে নিন কি পাচ্ছি!’
যারা হামিদুলকে সংবর্ধনা দিয়ে স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্বে ভাগ বসানোর অপেক্ষায় তারা কি এই দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছেন?
No comments:
Post a Comment