(এটা ঠিক গল্প নয়। আমি আসলে গল্প লিখতে জানি না।
সত্য ঘটনার চরিত্রগুলো ঠিক রেখে শুধুই নাম বদলে এখানে তুলে রাখলাম। এটা আমাদের স্কুলের
স্যুভিনির জন্য লিখেছিলাম।)
চারদিকে যেন উত্সবের আমেজ। গন্ডার দিয়া গ্রামে পার্বন লেগেছে!
মে মাসের এই সময়টাতে এমন দেখা যায় না। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মাইকিংয়ের শব্দ, পূর্বপাড়া
থেকে পশ্চিমপাড়া। বাজারে, স্কুলের মোড়ে মসজিদে সবখানেই ওই একটাই আলোচনা। ছেলে-বুড়ো
সবাই এমন এক সুরে কবে যে শেষ কথা বলেছে তা মনে করতে পারছিলেন না নব্বই ছুঁই ছুঁই
করা ফজর আলী মেম্বার।
হবেই না কেন? আজ যে গন্ডার দিয়া সরকারি প্রাথমিক স্কুলের
প্রধান শিক্ষক মমতাজউদ্দিন মজুমদারের বিদায় সংবর্ধনা। বিদায়ের সঙ্গে কষ্টের বসবাস
সব সময়ই। কিন্তু তার এই বিদায়ের রাগীনিতে উত্সবের ছোঁয়াটাও আছে। তিনি যে জাতীয় পর্যায়ে
দুইবারের স্বর্ণপদক জয়ী শিক্ষক। এলাকার গর্ব। তার মতো একজন মানুষকে তো আর সাদামাটাভাবে
বিদায় দেয়া যায় না। তাইতো গত দুই সপ্তাহ ধরেই প্রস্তুতি চলছে। লেখা হয়েছে বিদায়
বাণী, কেনা হয়েছে উপহার, তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। মনোহরদীর টিএনও সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন
তিনি হাজির থেকে বিদায় জানাবেন। মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। ধারণা করা
হচ্ছে, মাঠ উপচে পড়বে মানুষে।
প্রিয় স্যারকে সংবর্ধনা দিতে চায় গ্রামের সবাই। কিন্তু
যাকে ঘিরে এতো আয়োজন সেই মমতাজউদ্দিন মজুমদার সকাল থেকেই মনমরা হয়ে আছেন। দুঃস্বপ্ন
দেখে ঘুম ভেঙেছে সেই মাঝরাতে। এরপর ঘুমোবার কত যে চেষ্টা করেছেন লাভ হয়নি। মেডিটেশনের
অভ্যাস আছে। সেটা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি।
দুঃস্বপ্নটা কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছেন না। অথচ আজ
গর্বভরে হাসিমুখে বিদায় নেয়ার দিন তার। তার অনেক পুরনো ছাত্রছাত্রীরা ব্যস্ততা
রেখে এরই মধ্যেই গ্রামে চলে এসেছে। সবাই দিনটা স্মরণীয় করে রাখতে চায়। শ্রদ্ধা জানাতে
চায় প্রিয় মমতাজ স্যারকে।
এইতো গতকাল শেষ বিকেলে আয়েশা এসেছিল তার স্বামী নিয়ে। সালাম
করে গেছেন স্যারকে। আয়েশা এখন ঢাকায় থাকে। কাজ করে সচিবালয়ে। স্বামী আর দুই সন্তান
নিয়ে আজিমপুর সরকারি কলোনিতে তার সুখের সংসার। অথচ দারিদ্র্যতার ছোঁবলে পরে শেষ
হয়ে যাচ্ছিল সব কিছু। সেটা ৩০ বছর আগের গল্প। মমতাজ স্যারের বয়সও তখন তেমন কিছু
নয়। ক্লাসের সবার খুটিনাটি আচরণই চোখে পড়তো তার। এভাবেই একদিন আবিষ্কার করলেন আয়েশা
প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ক্লাসেও আসছে অনিয়মিত। এক-দুই ক্লাস করে অসুস্থতার কথা
বলে চলে যাচ্ছে বাড়িতে। অথচ মেয়েটা অনেক মেধাবী। নিশ্চিত ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে
বৃত্তি পাবে।
মমতাজউদ্দিন মজুমদার বুঝতে পারলেন কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে।
আয়েশার বাড়ি পাশের দাইদারি গ্রামে। সাইকেল নিয়ে সোজা চলে গেলেন সেখানে। খুঁজে বের করলেন
আয়েশার বাবাকে। এরপরই বেরিয়ে আসলো ঘটনা।
তিনবেলার মধ্যে যদি একবেলাও খাবার না জুটে তাহলে কি আর
পড়ায় মন বসে? স্কুল থেকে শরীর খারাপের কথা বলে এসে প্রায় প্রতিদিনই আয়েশা কাজ করতো
পাশের ভুঁইয়া বাড়িতে। তাতেই জুটতো একবেলার খাবার। এমন ঘটনা নাড়িয়ে দিল মমতাজ স্যারকে।
আয়েশার বাবাকে বললেন, ‘বৃত্তি পরীক্ষার আগে ও আমার বাড়িতে থেকে পড়বে।’
তাই হলো। তিন মাস পেট পুড়ে খেয়ে পড়াশুনা করে ট্যালেন্টপুলে
বৃত্তি পেল আয়েশা। এরপর হাইস্কুলে পড়ার সময়ও খরচের একটা অংশ আয়েশাকে দিয়েছেন মমতাজ
স্যার। উনার মতো মানুষের সংবর্ধনায় না থেকে কি পারা যায়?
এমন অনেকেই গতকাল এসে পা ছুঁইয়ে সালাম করে গেছেন তাদের প্রিয়
স্যারকে।
কিন্তু মমতাজউদ্দিন মজুমদার স্বস্তিতে নেই। ফজরের নামাজ
পড়ে সরকার বাড়ির পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে এসেছেন। কথাও বলেছেন কয়েকজনের সঙ্গে। তারপরও
মন ভাল হচ্ছে না। পুরনো একট স্মৃতি ফিরে এসেছে আবার। সবাই যেখানে তাকে সফল আর আদর্শ
শিক্ষক বলছে, সেখানে নিজেকে শুধুই ব্যর্থ নয় অপরাধীও মনে হচ্ছে মমতাজ স্যারের।
গতকাল গভীর রাতে দেখা স্বপ্নটা যে নিছকই স্বপ্ন নয়।
সেটা যে তার জীবনের ঘটে যাওয়া এক ঘটনা। আজকের এই বিদায়ের দিনে এসে নিজেকে আর ক্ষমা
করতে পারছেন না তিনি।
এই যখন ভাবছিলেন, তখন বাড়ির বাইরে থেকে কেউ একজন ডাকছিলেন
স্যারকে। অনিচ্ছা নিয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরে গেলেন। গফুর চেয়ারম্যান এসেছেন। স্যারকে জড়িয়ে
ধরে বললেন, ‘আপনার
কাছে আমাদের অনেক ঋণ। আমি ঠিক করেছি স্বর্ণের মেডেল আজ আপনার গলায় পড়িয়ে দেব।’
সকালের নাস্তা পড়ে রয়েছে সামনে। বছর কয়েক আগে ডায়াবেটিস
হয়েছে। তাইতো নিয়ম মেনে চলতে হয়। দুটো আটার রুটি আর আলুর ভাজি। কিন্তু আজ মুখে যে কিছুই
উঠছে না।
সেই স্বপ্নটা যেন গ্রাস করে ফেলেছে তাকে।
ভাবনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে মমতাজউদ্দিন মজুমদার চলে গেলেন
২০ বছর আগে। তখন মাত্রই প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। এমনিতেই নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপারে দারুণ
কঠোর তিনি। এবার তো দায়িত্বটা আরো বেড়ে গেল।
গন্ডার দিয়া সরকারী প্রাথমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায়
ফেল করার তেমন রেকর্ড নেই। মমতাজ স্যারের কল্যাণে এটি উপজেলার সেরা প্রাইমারী স্কুলের
একটি। কিন্তু এবার সেই নিয়মের ব্যাতিক্রমটাই যেন ঘটলো। ক্লাস ফাইভের ফাইনাল
পরীক্ষায় ফেল করলো পুর্ব পাড়ার সালমা। পুরো স্কুলে ফেল ওই একজনই।
সবাই যখন রেজাল্ট নিয়ে হাঁসিমুখে বাড়ির পথে, সালমা তখন
দাঁড়িয়ে টিচার্স রুমের সামনে। এই মুখ নিয়ে বাড়ি যাবে কি করে? আবার স্যারদের সামনে যেতেও
লজ্জা পাচ্ছে!
সালমার এমন অসহায়ভাবে দাড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা খেয়াল করছিলেন
স্কুলের পুরনো দপ্তরি রমজান আলী। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কিরে
কী হয়েছে তোর?’
সালমা পুরো ঘটনা খুলে বললো রমজান চাচাকে। রমজান আলীও
তার মতো করে একটা বুদ্ধি বের করলেন। বললেন, ‘কিছু টাকা এনে স্যারদের খাওয়াও। তারা তোমারে পাশ
করাইয়া দিব।’
প্রস্তাবটা খারাপ মনে হলো না সালমার। কিন্তু সমস্যা হলো
ও টাকা পাবে কোথায়? বাড়িতে ফেল করার কথা বলবে নাকি চুরি করে টাকা জোগাড় করবে তাই
নিয়ে দ্বিধায় থাকলো কিছুক্ষণ। কিন্তু ঘরে তো তেমন কিছুই নেই। কী বিক্রি করবে? তেমন
কিছুই খুঁজে না পেয়ে চোখ গেল চালের ড্রামের দিকে। ঢাকনা খুলতেই দেখলো সেখানে কিছু
চাল জমা আছে। তাই তুলে নিল গামছায়। বাজারে নিয়ে তা বিক্রি করে ৮ টাকা পেল।
সেই টাকা নিয়ে যখন স্কুলে গেল তখন সাড়ে তিনটা বাজে প্রায়।
কিছুক্ষণ পরই স্যার’রা
বাড়ি চলে যাবেন। ভাবলো, সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কোন অর্থ হয় না। সালাম দিয়ে
সালমা ঢুকে পড়ে টিচারদের রুমে।
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মুখস্ত বুলির মতো বলতে থাকে, ‘স্যার
আমারে পাশ করাইয়া দেন। আমি ৮ টাকা নিয়া আইছি। এইটা দিয়া আপনাদের চা-বিস্কুট কিন্না
দেই। আমারে ফিরাইয়া দিয়েন না স্যার। আমি ক্লাস সিক্সে উঠতে চাই। আমি পড়া লেখা করতে
চাই।’
জলিল স্যার বয়স্ক মানুষ। তার মেজাজ সারাক্ষণই চড়া। এমন
কথা শুনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘তোর
এত্তো বড় সাহস! ঘুষ দিতে আইছস। যা এক্ষুনি!’ জলিল স্যার তো মারতেই যাচ্ছিলেন। তাকে থামালেন
তানিয়া ম্যাডাম।
মমতাজউদ্দিন পুরো বিষয়টাই দেখছিলেন। তিনি শিক্ষক মানুষ।
নিয়মের বাইরে তো আর যেতে পারেন না। কিন্তু আবেগ বলেও তো একটা কথা আছে। কিছুক্ষণ
ভাবলেন। শেষে সালমাকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই। ভালভাবে পড়াশোনা করো।
পরেরবার পাশ করে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠো।’
স্যারদের এমন কথা আর আচরণের পরও বেশ ক্ষানিকক্ষণ সালমা
দাঁড়িয়েছিল। চোখের জলও ফেলছিল। যদি তাতে কিছুটা দয়া হয়! কিন্তু হলো না।
এবার বিপদটাতো আরো বেড়ে গেল। ফেলের সঙ্গে যোগ হলো চুরি!
কী করবে সালমা ভেবে উঠতে পারে না। অস্থিরতা বেড়ে যায় আরো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু কোন মুখে ফিরবে ও?
ভুঁইয়া বাড়ির বাগানের বেল গাছে সালমার ঝুলন্ত লাশ দেখে
পরদিন ভোর হয় গন্ডারদিয়া গ্রামে। আ্ত্তহত্যা করে সালমা। সবাই এটাই জানতে পারে
চুরির লজ্জা থেকে বাঁচতেই আ্তাাহুতি দিয়েছে ১১ বছর বয়সী মেয়েটি।
স্বপ্নে দেখা এই বাস্তব ঘটনাই যখন পোড়াচ্ছিল মমতাজ
স্যারকে, তখন আবার বাইরে থেকে ডাক আসে- ‘স্যার চলেন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় হইছে।’
স্কুলের দপ্তরি বদি মিয়া নিতে এসেছে মমতাজ স্যারকে। কিন্তু কিছুতেই যে সেখানে যেতে
মন চাইছে না তার। তার মতো একজন ব্যর্থ মানুষের জন্য সংবর্ধনা-টংবর্ধনা কেন?
সালমার ওই মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করেন তিনি। ওই
দিন তাকে পাশ করিয়ে দিলে এমন ঘটনা হয়তো ঘটতো না। সবাই যাই জানুক তিনি জানেন এই
মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী।
স্বপ্নে দেখা সালমার সেই আর্তনাদ কানে বাজছে- ‘স্যার
আমারে বাঁচতে দিলেন না।’
বাড়ির বাইরে থেকে বদি মিয়ার আবার তাড়া ‘স্যার
জলদি আসেন।’
গ্রামের চিকন আইল ধরে মমতাজউদ্দিন ধরেছেন স্কুলের পথ।
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাইকে কেউ একজন বলছে ‘এলাকার গর্ব, দুইবারের স্বর্ণপদক জয়ী সফল শিক্ষক
মমতাজ স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হবেন।’
শ্রেষ্ঠ, সফল, গর্ব এই শব্দগুলো জ্বালা দিতে থাকে স্যারকে।
মমতাজউদ্দিন মজুমদার ভাবতে থাকেন, আজ এমন দিনে আমার ওই অপরাধের গল্পটাও সবার জানা উচিত।
তাতে যদি ‘পাপ’
বোধ কিছুটা কমে!
মাথা নিচু করে স্কুল মাঠ দিয়ে হেটে যাচ্ছেন মমতাজ স্যার।
দু পাশে সহস্র হাতের করতালি। প্রায় সবাই তার ছাত্র-ছাত্রী। সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা
জানাচ্ছে প্রিয় স্যারকে। কিন্তু মমতাজউদ্দিন মজুমদার তখন অন্য এক জগতে! চোখের জল
ফেলে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কানে বাজতে থাকে সেই মর্মস্পর্শী আর্তনাদ- ‘স্যার
আমারে বাঁচতে দিলেন না।’
মাথাটা আরো নিচু হয়ে যায় স্যারের। পা যেন চলছেই না। হু
হু করে উঠে মনটা। চোখে তখন নোনা জলের বন্যা।
২০ বছরের জমানো জলের ধারা কী এতো সহজে থামে!