Monday, December 17, 2007

হাসির মুখে হাসি নেই...

সেই শুরু থেকেই তিনি অন্যদের চেয়ে একটু অন্যরকম। জন্মের পর পৃথিবীর আলো দেখে কান্না নয়, হাসি ছিল তার মুখে। আর তাই তো বাবা-মা শখ করে নাম রেখেছিলেন হাসি, হাসিনা বেগম হাসি! শত সমস্যাকে একপাশে সরিয়ে হাসিখুশিভাবেই দিন কাটছিল রাজশাহীতে জন্ম নেয়া এই তরুণীর। সামনে ছিল জীবনকে বদলে ফেলার হাতছানি। কিন্তু হুট করেই দুমাস আগে এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। হাসির মুখে হাসি নেই! চোখে জল! বিষ্ন্ন হয়ে থাকেন সারাক্ষণ।

আসলে এছাড়া কিইবা করার আছে হাসির? জীবনের সব স্বপ্নই তো বিবর্ণ হয়ে গেছে প্রায়। চেনা জীবনটা এখন অচেনা ঠেকছে জাতীয় ফুটবল দলের এই স্ট্রাইকারের কাছে। একটু ভুল বলা হলো, হাসিনা বেগম হাসি তো এখন আর জাতীয় দলে নেই। ভবিষ্যতে ফিরতে পারবেন কিনা সেটাও ঝুলে আছেযদি ওপর। বাঁ পায়ের হাড়ে টিউমার হয়েছে। এমআরআই করার পর ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন সমস্যাটা মামুলি নয়। অসে¿াপচার করালে সমস্যা সারবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা থাকছে! যেমনটা বলছিলেন তিনি, ‘পিজি হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমাকে সরাসরিই বলেছেন অপারেশন করালে আমি আর মাঠে নামতে পারব না। এমনকি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে গেলেও সমস্যা হবে। হাড়ের মধ্যে টিউমার থাকায় তারা অসে¿াপচারের আগে বেশ চিন্তিত।এর অর্থ তাহলে কি দাঁড়ালো-আর মাঠে ফিরতে পারবেন না তিনি? না তেমনটা নয়। কিছুটা আশার কথাও শুনেছেন ডাক্তারদের কাছ থেকে, ‘তারা বলেছেন ব্যাংকক কিংবা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করালে আমি আবার সুস্থ হয়ে উঠব। আবার নামতে পারব মাঠে।

কিন্তু ডাক্তাররা বললেই তো হবে না, কে তাকে করাবে সেই ব্যয়বহুল চিকিৎসা? সংসারে বাবা নেই। উপার্জনম একমাত্র ভাইটি চার বোন আর মাকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খায়। সেখানে তারও তো কিছু করার নেই। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন শুরুতে এগিয়ে এলেও এখন ব্যাপারে অনেকটাই নীরব।

অথচ জাতীয় সম্পদই হয়ে উঠেছিলেন হাসি। জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুর আগে খেলেছেন হ্যান্ডবল। বিজেএমসির হয়ে তার পারফরমেন্স মন্দ নয়। কিন্তু সবসময়ই মন পড়ে ছিল ফুটবলে। সেই ছোটবেলায় রাজশাহীতে ফুটবল খেলতেন। কাস এইটে পড়ার সময় ছেলেদের সঙ্গে টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েও হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। পরিবার থেকে সহযোগিতা পেয়ে এক সময় তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ২০০৪ সালে মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছেন ঢাকা জেলার হয়ে। আর প্রথম সেই টুর্নামেন্টে চার ম্যাচ খেলে ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনটিতেই। মহিলা জাতীয় দলের হয়ে তার শুরুটা হয়েছে এর এক বছর পর ২০০৫ সালে, এএফসি কাপে। সেখানে হংকংয়ের বিপে খেলতে গিয়েই প্রথম ব্যথা অনুভব করেন পায়ে। তারপরও গোল পেয়েছেন। ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে খেলে গেছেন এরপর। প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাতীয় দলকে। হার মেনে যাওয়া শব্দটা নেই তার অভিধানে।
কিন্তু গত রোজায় ইন্দো-বাংলা গেমসের জন্য অনুশীলন করতে গিয়ে আবারো সেই পুরনো ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েন হাসিনা বেগম হাসি। ব্যথা নিয়েই ছাড়েন ক্যাম্প। এরপরই তো হাতে আসে সেই এমআরআই রিপোর্ট।

এখন মাঠে নামার সামর্থ্য নেই তার। কিন্তু মন তো আর মানে না। মনটা পড়ে আছে মাঠে। তাই তো ধানমন্ডি ক্রীড়া কমপ্লেক্সে চলতে থাকা দ্বিতীয় মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টের ম্যাচ দেখতে প্রায়ই হাজির থাকছেন হাসি। খেলা দেখতে দেখতেই বিষন্ন হয়ে উঠছেন! তিনি মনে করেন দেশকে আরো অনেক কিছুই দেয়ার সামর্থ্য আছে তার, ‘আমার সামনে পুরো ক্যারিয়ারই পড়ে আছে। মহিলা ফুটবলে প্রিয় বাংলাদেশকে আরো অনেক দুর নিয়ে যেতে চাই আমি। যেখানে খেলাধুলার প্রতি মেয়েদের অনাগ্রহ সেখানে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে চাই, চাই আমাকে দেখে দেখে যেন মেয়েরা ফুটবলে আসুক।

এখন তো এসব কিছু শুধুই হাসির স্বপ্ন। তার চলার পথটা অমসৃণ হয়ে উঠেছে! পায়ের এই চিকিৎসার জন্য কে তার দিকে বাড়িয়ে দেবে হাত? কোন স্বহ্দয়বান মানুষ? নাকি তাকে সারিয়ে তোলাটা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্ব নাকি রাস্ট্রের?

এত কিছু জানেন না হাসি। তার একটাই ইচ্ছা দ্রুত আবার মাঠে ফেরা।মাঠের বাইরে থেকে অস্থির হয়ে উঠেছি। আর ভালো লাগছে না। মন চাইছে এই পা নিয়েই এক্ষুণি মাঠে নেমে পড়ি!’

চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিলেন হাসতে ভুলে যাওয়া হাসি!

(
আমাদের ফটো সাংবাদিক আলিম ভাইয়ের অনুরোধে লিখেছিলাম এই লেখাটা।
১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে আমাদের পত্রিকায়। এখানে তা তুলে রাখলাম।)

No comments: