এমন একটা ব্যস্ত দিন শেষ হতেই ক্লান্তি উবে গিয়ে ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল...’
জীবন সত্যিই সুন্দর 🏊 👣
এমন একটা ব্যস্ত দিন শেষ হতেই ক্লান্তি উবে গিয়ে ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল...’
জীবন সত্যিই সুন্দর 🏊 👣
‘এই কুলফি লাগবে কুলফি...’ -দূর থেকে কাছে আসছিল শব্দটা! গলিতে উঁচু গলায় এমন হাঁকডাকে কেমন যেন স্বস্তির পরশ ছুঁয়ে গেল। প্রচন্ড গরমের কারণে কিনা কে জানে কুলফি মালাই- শব্দ দুটো কানে আসতেই অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। খাঁটি দুধে চিনি, এলাচ, বাদাম, কিশমিশ আর গরম মসলার মিশ্রণে এক অমৃত স্বাদের আইসক্রিম! ১৬শ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যে যে হিমায়িত মিষ্টান্নের পথ চলা, তার আঁতুড় ঘর এখন কুষ্টিয়া।
ঢাকার অলি-গলিতে কান পাতলে প্রায়ই ভেসে আসে- কুষ্টিয়ার রশিদ ভাইয়ের কুলফি মালাইয়ের বিজ্ঞাপন। সেটা কতোটুকু খাঁটি তা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই! তবে সত্যিকারের কুলফি মালাই পেতে আপনাকে আসতে হবে সীমান্তবর্তী অঞ্চল কুষ্টিয়ায়।
স্বাদের সঙ্গে সুঘ্রাণেরও যে নিবিড় একটা সম্পর্ক আছে, সেটা তুলোর মতো নরম কুলফিতে কামড় দিয়ে আঁচ করতে পারলাম। কুষ্টিয়ায় বেড়াতে এসে স্বাদ নেওয়া হলো কুলফি মালাইয়ের। দৌলতপুরের আল্লার দর্গায় দেখা মিলল ৩৭ বছর বয়সী যুবক মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে। যার জন্মের পরের পুরোটাতেই জড়িয়ে আছে লালন সাঁইজির অঞ্চলের এই ডেজার্ট!
কুমারখালির উত্তর কয়ার ছেলে আশরাফুল। এটা জানিয়ে রাখা ভাল- কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া আর শিলাইদহ'র বেশ কয়েকটি গ্রামের অনেকেই পেশায় কুলফি বিক্রেতা! আশরাফুলও তাদের একজন। যিনি নিজের তৈরি কুলফি সিলভারের হাঁড়িতে নিয়ে ঘুরে বেড়ান কুষ্টিয়া আর কুমারখালীর রাস্তায়!
অভাবের সংসারে বেড়ে উঠা আশরাফুলের। বাবা নেশার জগতে গিয়ে বিক্রি করে দেন শেষ সম্বল ভিটেটুকুও। তিনভাই পড়ে যান অকুল পাথারে। ঠিক তখনই কিশোর আশরাফুল পেয়ে যান আব্দুল জলিল মিয়ার দেখা। এই নামটা এই অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত। কারণ তার হাত ধরেই যে কুলফি সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি বেঁচে নেই, তার ছেলেরাই এখন বাবার ব্যবসা আর সুনামের হাল ধরেছেন।
জলিল মিয়ার কাছেই আশরাফুলের হাতেখড়ি। শিখেছেন কিভাবে গরুর খাঁটি দুধের সঙ্গে কিশমিশ, চিনি আর সামান্য মসলায় যাদুকরী স্বাদের মালাই তৈরি করা সম্ভব। ব্যস এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। আশরাফুল বলছিলেন, ‘ওস্তাদ শিখাই দিতিই আমি আর এলাকায় থাকলাম না। সুজা চইলি গেলাম ঢাকায়। মিরপুর, খিলগাঁও, ফার্মগেট ম্যালা জাগাতেই ফেরি কইরি বিক্রি করিছি কুলফি মালাই। বলতি পারেন এরপরই আমার দিন ফেরেছে!’
বাবা ছিলেন সংসার বিবাগী, অগোছালো। আশরাফুল পিতার বেখেয়ালি জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে একেবারেই এক সংসারী মানুষ। যখন হাতে কিছু পয়সা এলো আর দেরি করেন নি, ফিরে এসেছেন কুষ্টিয়ায়, কয়া গ্রামে। সংসার পেতেছেন। সন্তানও হয়েছে। নিজের জীবনের গল্পটা বলছিলেন, ‘বড় কিছু করার ইচ্ছা নিকো আমার। সব সুময় ঝামেলা মুক্ত থাকতি চাই। এই কারণেই ঢাকায় থাকলাম না। চইলি আলাম গ্রামে। এখন এক ছেলে আর এক মেয়ের সংসার আমার। ভালই আছি আমি।’
মহামারি করোনা এসে গরমে ব্যবসার ঠিক সময়ে বড় ক্ষতি করে দিয়েছে আশরাফুলের। এমনিতে মাস শেষে কম করে হলেও ২০ হাজার টাকা লাভ থাকে। কিন্তু করোনার সময়ে অনেকেই ভয়ে ঠান্ডা মালাই খেতে চায় না। আবার শীতকালে তো আইসক্রিম চলেই না। তখন অবশ্য বসে থাকার মানুষ নন আশরাফুল। কুষ্টিয়ার আরেক বিখ্যাত খাবার তিলের খাজা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
যদিও কুলফি মালাই বিক্রেতা হিসেবেই নিজের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তিনি। কারণ এই খাবারটায় যে তার নিজের স্বাদ, রুচি লেগে আছে। নিজের হাতেই প্রতিদিন তৈরি করেন কুলফি। প্রতিদিন ২০ কেজি দুধ জ্বাল দেওয়ার কাজটা অবশ্য তার ঘরণীই করে। স্বাদের বাকি সিক্রেট থাকে তার হাতে! ১০০ থেকে ১৫০ পিস কুলফি নিয়ে বের হন প্রতিদিন। ১০, ২০, ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকায় মেলে একেকটি কুলফি।
লালসালু কাপড়ে মোড়ানো সিলভারের পাতিলে বরফের আড়ালে রাখা কুলফি নিয়ে হাঁক দেন রাস্তায়, অলিতে গলিতে। আশরাফুলের কী ইচ্ছে করে না ব্যবসাটা আরও বড় করতে। নিজের নামে বিজ্ঞাপন করে আরও নাম কামাতে?
-প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে কুলফি'র কাবুলিওয়ালা বলছিলেন, ‘বুঝতি পারছি আপনে রশিদের কথা বলতি চাইছেন। আসলে সত্যি হলো জিনিস ভালো হলি অ্যাডভার্টাইজের দরকার হয় না। মানুষ আপনেক এমনি খুঁজি নিবি।’ আশরাফুলের তৈরি খাঁটি দুধের কুলফিতে কামড় দিয়ে এই কথাটাই মনে হলো আমার! মনে হচ্ছে আমি নিজেও হয়তো এখানে পা রাখলে খুঁজে নেবো তাকে!
তবে কিছুতেই এই পেশায় নিয়ে আসতে চান না ছেলেকে। এভাবে ফেরি করা কষ্টের জীবন দিতে চান না ছেলেকে। আশরাফুল বলছিলেন, ‘ম্যালা সময় নিয়ে বানানো এরপর মাথায় করি ৩০ কেজি ওজনের পাতিল নিয়ে ঘুরি বেড়ানো অনেক কঠিন কাজ। এটা আমি কখনোই আমার ছেলেকে করতি দেবো না। ওকে বলেছি তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর। যা কষ্ট করার আমিই করি!’
কথাটা শেষ করেই অবশ্য জিভে কামড় দিলেন আশরাফুল। না একটুও কষ্ট নেই তার। তিনি সুখী। কোনো দুঃখ নেই। হাসি মুখে জানাচ্ছিলেন, ‘যখন আপনাগোর মতো মানুষরা আমার কুলফিতে কামড় দিয়ে দুটা প্রশংসা করে তখন সব ভুইলে যাই। মনে হয় আমার জন্মই তো হয়েছে কুলফি বেচার জন্য!’
এভাবে ভাবতে পারেন বলেই শত অভাবের মাঝেও আশরাফুলদের জীবন সুন্দর। তাদের বেঁচে থাকাটা আরও সুন্দর! কথাগুলো যখন ভাবছিলাম তখন কাছ থেকে আরও দূরে হারিয়ে গেল আশরাফুলের চড়া গলা-‘এই কুলফি লাগবে কুলফি...!’
অনেক দিন তো বাস মালিকদের স্বার্থ দেখা হলো, স্বাস্থ্যবিধিকে যখন বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে তখন ৬০% বাড়তি ভাড়াই দিয়ে যাবো কেন?
মহামারির সময়ে সাধারণের দুঃখ-কষ্টের কথা একটু ভাবুন, আগের ভাড়া ফিরিয়ে
আনুন প্লিজ! স্বাস্থ্যবিধি শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব ঠিক রেখে দুই সিটে এক
যাত্রী যখন বসানো হচ্ছে না, তখন বাড়তি ভাড়া দেবে কেন জনগন?
আপনার গান শুনেই বেড়ে উঠেছি আমরা। বিনোদন মানেই তখন বাংলাদেশ বেতার। যেখানে সিনেমার গান মানেই এন্ড্রু কিশোর। অনুরোধের আসর, গানের ডালি, দুর্বার কিংবা নাজমুল হুসাইনের ধারা বনর্নায় ১৫ মিনিটের সিনেমার ট্রেলর! দুই ব্যাটারির রেডিও থেকে টেপ রেকর্ডার...আমাদের শৈশবের একটা দিনও সম্ভবত আপনার গান ছাড়া কাটেনি।
শুনতে না চাইলেও রেডিওতে, ক্যাসেট প্লেয়ার এমন কী পাড়া-মহল্লা কাঁপিয়ে মাইকে এখানে সেখানে কোথাও না কোথায় বেজে উঠতো আপনার গলায়... ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, কিংবা ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। কতোশতবার শুনেছি ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’... ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’,‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, কিংবা ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া...এমন কতশত গান বলে শেষ করা যাবে না।
২৩ বছর আগে শীতের এক শেষ বিকেলে চলে গিয়েছিলেন আপনি।
ক্লান্ত একটা দিনের শেষে গোধূলী যখন বিষন্ন আলো ছড়িয়েছে তখন আকাশ-পাতাল এক করে আমরা কেঁদেছি। আম্মা আর আমরা চার ভাইবোন! এখনো আমি কাঁদি, যা কিঞ্চিৎ প্রার্থনা তার শেষটাতে এসে আকুল হয়ে কাঁদি, নোনা জলের ঝাপটায় ঝাপসা হয়ে ওঠে চোখ! সেই চোখের জল শুকিয়ে গেলে গলার কাছে এসে কষ্টরা আহাজারি করে.. তখন আরও বেশি যন্ত্রণায় পুঁড়ি।
কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু এখনো এতোদিন পরও আপনাকে খুঁজে বেড়াই। জীবন যুদ্ধে খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলে বটবৃক্ষের সেই ছায়া, শাসন আর সাহসের শিকড় খুঁজে বেড়াই।
জানি আপনি আর ফিরে আসবেন না আব্বা; কিন্তু ওপারে ওই দুনিয়াতে আপনি যেন সুখে থাকেন সেই প্রার্থনা করে যাই অহর্নিশ। করুণাময় নিশ্চয়ই শীতল ছায়া দিয়ে রেখেছেন আপনাকে। আর এটাও জানি নিশ্চয়ই সেই রহস্যময় জগতে বসেও বিশ্রাম নেই আপনার, আমাদের মঙ্গল কামনায় তসবিহ জপে যাচ্ছেন, ক্লান্তিবিহীন নিরন্তর....!
বাবা'রা তো এমনই হয়!