Friday, February 5, 2010

টাকা বাঁচাতে..

পাড়া-মহল্লার খেলাধুলায় এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু এসএ গেমসের মতো এতো বড় মাপের আসরেও এমন ঘটনা ঘটবে ভাবেনি কেউ! গতকাল মহিলা ফুটবলের ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কান ফুটবল দলের। কিন্তু সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচ না খেলে দেশে ফিরে গেছে তারা। অ্যাথলেটিক্সসহ বেশ কয়েকটি ইভেন্টের জন্য কালই যে চার্টার বিমানে লঙ্কান অ্যাথলিটরা ঢাকা আসেন তাতে করেই বাংলাদেশ ছেড়েছেন তারা।
আসলে এমনিতেই প্রথম দুটো ম্যাচ হেরে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। কাল সকালের ম্যাচটি অনেকটা দায়সারার ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। জিতলেও পদক জেতার লড়াইয়ে ফেরা হতো না। প্রথম ম্যাচে তারা নেপালের কাছে হেরেছিল ০-৮ গোলে। পরের ম্যাচে বাংলাদেশ তাদের হারিয়েছিল ২-০ গোলে। তাই শেষ ম্যাচে জিতলেও এই ইভেন্ট থেকে তাদের পদকের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাই সময়ের সঙ্গে টাকাকড়ির খরচ বাঁচাতে গতকালই ঢাকা ছেড়েছেন তারা। কাল দলের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, টাকা বাঁচাতেই ওই ম্যাচ না খেলে চলে গেছে তারা। এমনিতে নিয়ম অনুয়াযী ইভেন্ট শেষ হওয়ার একদিন পর থেকেই আয়োজকদের পক্ষ থেকে খরচ বন্ধ করে দেয়া হয়।
তখন থাকতে গেলে নিজেদের খরচেই থাকতে হয়। এ অবস্থায় ফ্লাইট জটিলতার কথা ভেবে সেই বিমানেই দেশে ফিরে গেছে লঙ্কান মহিলা ফুটবল দল।একেবারে সাদা চোখে দেখলে হয়তো বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু অলিম্পিক স্পিরিটের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্রীলঙ্কান দলের এমন চলে যাওয়াটাকে ভালো চোখে দেখছে না দেশটির মিডিয়া। —শুধ কি টাকা বাঁচাতে এমন সিদ্ধান্ত? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে ১১তম এসএ গেমসের শ্রীলঙ্কান দলের অন্যতম সমন্বয়কারী রিসাল লতিফকে। তিনি বলছিলেন, ‘আসলে এছাড়া অন্য কিছু করার ছিল না আমাদের। দেশ থেকে আমাদের অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হেমসে ফার্নান্ডো স্পষ্ট জানিয়েছেন, যে ম্যাচ খেলেও লাভ নেই তা খেলার দরকার কি। তাছাড়া এই বিমানে না আসলে তো ১০ ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে। এতোদিন থেকে বাড়তি অর্থ খরচের কোনো মানে নেই!’ রিসাল লতিফ জানালেন, কলম্বো থেকে ওই বার্তা আসার পর ম্যাচ না খেলেই তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।তবে পাকিস্তানকে গতকাল ওয়াকওভার দেয়ার আগে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে নাকি কথা বলেছে শ্রীলঙ্কান দল। পরিস্থিতি পুরোটা জানিয়ে তবেই দেশ ছেড়েছে।
তারা ছাড়াও সেই চার্টার বিমানে ঢাকা ছেড়েছে শ্রীলঙ্কান ওয়েটলিফটিং, সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টন এবং কাবাডি দল। এসেছে অ্যাথলেটিক্স, সুইমিং, বক্সিং, কারাতে, রেসলিং এবং টেবিল টেনিস দল। যদিও গতকাল এসএ গেমস টেকনিক্যাল উপকমিটির সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু বলছিলেন— ম্যাচ না খেলে শ্রীলঙ্কান মহিলা দলের চলে যাওয়া সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। তবে তিনি এটা নিশ্চিত করেছেন, এ নিয়ে ফুটবল ফেডারেশন শিগগিরই তদন্ত কমিটি গঠন করবে। ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এফএসি)। এটা পুরোপুরি এএফসির ব্যাপার। এক্ষেত্রে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে লঙ্কান মহিলা ফুটবল দলকে। তবে এসবই এখন কেবল প্রাথমিক অনুমান। তদন্ত রিপোর্ট দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু।
বাংলাদেশে যে কোনো ঘটনার তদন্তে কমিটি গঠনটা হয় খুব জোরেশোরে। সেই কমিটি আবার বেশ কিছুদিন হাঁকডাকও করে। কিন্তু এমন সব তদন্তের কয়টির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেছে, সেই প্রশ্নে কর্তাদের কাছে মিলল মুচকি হাসি!

Thursday, February 4, 2010

‘আফগানিস্তান আর মৃত্যুপুরী নয়, পৃথিবীর সেরা দেশ’

কিছু কমন প্রশ্ন এতো বেশি শুনতে হচ্ছে যে বিরক্তি ধরে গেছে! তাই কথা বলার শুরুতেই মোহাম্মদ মোস্তফা কামান্দ স্পষ্ট জানিয়ে রাখলেন, ‘দয়া করে যুদ্ধ, তালেবান কিংবা ওসামা বিন লাদেন—এসব নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। অনেক হয়েছে, এবার আমরা আফগানরা দৃষ্টি ফেরাতে চাই অন্যদিকে।’ আসলেই তো অনেক হয়েছে। সেই ১৭৪৭ সালে আহমেদ শাহ দুরানি দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার দেশটিকে নতুন সাম্রাজ্য ঘোষণার পর থেকেই চলছে অস্থিরতা। এরপর ১৯১৯ সালের অপয়া ১৯ আগস্টে শুরু ‘দ্য গ্রেট গেম’ বলে পরিচিতি পাওয়া তৃতীয় আংলো-আফগানিস্তান যুদ্ধ। ব্রিটিশ-সোভিয়েতের সেই যুদ্ধে গিনিপিক হতে হয়েছে সাধারণ আফগানদের। ’৭০-এর আলোচিত সিভিল ওয়ারের পর এখন চলছে মার্কিন মিত্র শক্তির তালেবান দমনের নামে ‘শান্তি মিশন’। ২০০১ থেকেই যুদ্ধের দাবানলে পুড়ছে দেশ।
যুদ্ধের মধ্যেই বেড়ে ওঠা আফগানিস্তানের এই প্রজন্ম সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছে! তাইতো এবারের এসএ গেমসে ৭৭ কেজি ভারোত্তোলনে ব্রোঞ্জজয়ী আফগান নাগরিক মোস্তফা কারমান্দ বলছিলেন, ‘এখন প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে আমাদের দেশের চেহারা। যুদ্ধ শেষ। আমরা ফুটবল খেলার মাঠ কিংবা ভারোত্তোলনের জিমন্যাসিয়াম সবকিছু আবার বুঝে পেয়েছি। শুধু কাবুল নয়, এখন পুরো দেশ থেকেই ক্রীড়াবিদরা উঠে আসছেন।’ যদিও এই মোস্তফা কারমান্দের চলার পথে আর দশজন আফগানের মতো কাঁটা বিছানো ছিল না। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের ধনী এক পরিবারে জন্ম তার। বাবা রহমুতুল্লাহ কারমান্দও একসময় ভারোত্তোলক ছিলেন। অলিম্পিক গেমসে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশের। এখন আফগান ওয়েটলিফটিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। বাবাকে দেখেই ভারোত্তোলনে নাম লেখান মোস্তফা। অবশ্য তাদের পরিবারের অন্য দু’ভাইও ভারোত্তোলক। যার মধ্যে একজন এখন খেলা ছেড়ে কাজ করছেন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অন্যজন পাড়ি জমিয়েছেন মার্কিন মুল্লুকে।
কিন্তু মোস্তফা কারমান্দের অন্য দেশে পাড়ি জমানোর ইচ্ছে নেই। খেলাধুলার বাইরে পড়াশোনা নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হয় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার এন্ড সায়েন্সে পড়া এই তরুণকে। জানালেন, লক্ষ্য আছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ভারোত্তোলক হওয়ার—‘দেখুন আমি কি করতে পারবো সেটা না ভেবে পরিশ্রম করে যেতে চাই। যদি লক্ষ্যের কথা বলেন তবে বলব, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হতে চাই আমি। এরপর যখন বয়সে কুলোবে না তখন দেশের সেবা করতে চাই।’
২০ বছর বয়সী এই তরুণের মতো এতোটা ভাগ্যবান নন এসএ গেমসে আফগান দলের আরেক ভারোত্তোলক মারওয়ান বিমার। তার জন্ম এমন এক জায়গায় যার নাম শুনলে ওসামা বিন লাদেনের কথা মনে পড়ে সবার। একসময়ের তালেবান নিয়ন্ত্রিত কান্দাহারে জন্ম মারওয়ান বিমারের। তিনি বলেন, এখন আসলেই পাল্টে যাচ্ছে আফগানিস্তানের চেহারা। এটি আর মৃত্যুপুরী নেই—‘মিথ্যে বলছি না, আমরা আফগানিস্তানে সত্যিই ভালো আছি। আবার শান্তি ফিরে এসেছে আমাদের দেশে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর আমাদের এই প্রজন্ম ক্রীড়ামুখী হয়ে উঠেছে। আসলে টেলিভিশনে অনেক কিছু দেখে আমাদের দেশ সম্পর্কে বাইরের বিশ্ব কিছুই বুঝতে পারছে না। ভুল তথ্য যাচ্ছে সবার কাছে। দেখুন, গত বছর বডি বিল্ডিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে হেলমন্দ নামের এক অচেনা এলাকার বাসিন্দা। গ্রামের মানুষও সব ভুলে মাঠে ফিরছে!’ তিন আরও জানালেন, দেশটিতে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা রেসলিং, সঙ্গে তায়কোয়ান্দো, ফুটবল, জুডো, ভারোত্তোলন; বাস্কেটবলেও আগ্রহ বাড়ছে। তবে এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো তারা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তি হবে—এমন দাবি মারওয়ান বিমারের।
ভবিষ্যতে কি হবে সেটা বলার সাধ্য অবশ্য কারো নেই। সেটা যাই হোক, যুদ্ধ কাটিয়ে দেশে শান্তিতো ফিরেছে, তাতেই খুশি আফগান ক্রীড়াদিরা। দলের ভারোত্তোলন কোচ মোহাম্মেদ আজম বলছিলেন, ‘আমার এই জীবনে অনেক কিছুই দেখেছি। এতো ভালো পরিবেশ আফগানিস্তানে আর আসেনি। বেশ শান্তিতে আছি! আপনাদেরকে বলছি—আমাদের দেশে এসে দেখুন, দেশটা কতো সুন্দর। আমি নিশ্চিত, মানুষগুলোর আতিথেয়তা মুগ্ধ করবে আপনাদের।’ এখানেই থামলেন না ষাটোর্ধ্ব এই কোচ। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি আমার দেশ নিয়ে সত্যিই অনেক গর্বিত! অনেক প্রলোভন এসেছিল দেশ ছেড়ে পালানোর। কিন্তু পালাইনি। এটাই পৃথিবীর সেরা দেশ, এটা ছেড়ে যাব কোথায়? এখানেই জন্ম আর এই দেশেই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকতে চাই।’
এমন দেশপ্রেম যারা ধারণ করেন তারাই আসলে পারেন ফিনিক্স পাখির মতো ধংসস্তূপ থেকে জেগে উঠতে!

Tuesday, February 2, 2010

মনোরঞ্জনের দাবি— স্বর্ণপদক তার!

রৌপ্যপদক জেতার পর সেটা গ্রহণ করার জন্য মঞ্চেই আসতে চাননি মনোরঞ্জন রায়। কেননা এভাবে হার মেনে নিতে হবে ভাবেননি বাংলাদেশের এই ভারোত্তোলক। গতকাল পুরুষদের ৭৭ কেজি ভারোত্তোলনে রৌপ্যজয়ী ক্ষুব্ধ মনোরঞ্জন বলছিলেন, ‘আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আসলে হামিদুল নয়, আমিই এই ইভেন্টের স্বর্ণপদক জিততাম। স্বর্ণপদক আমার! কিন্তু আমাকে সেই পদক জেতার সুযোগ দেয়া হয়নি। আমি চেয়েছিলাম ক্লিন অ্যান্ড জার্ক রাউন্ডেও হামিদুলকে টপকে যেতে। কিন্তু আমি বৈষম্যের শিকার। ওরা সুযোগটা আমাকে দিল না। বললো তোমার স্বর্ণপদকের দরকার নেই!’
গতকাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জিমন্যাশিয়ামে তাইতো চোখের পানি মুছতে মুছতে সাংবাদিকদের সামনে এলেন সেনাবাহিনীর এই সদস্য। ৭৭ কেজি ইভেন্টের স্ন্যাচ রাউন্ডে হামিদুলের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনিই। তুলেছিলেন ১২০ কেজি। উল্টোদিকে হামিদুল তোলেন ১১৭ কেজি। পরে ক্লিন ও জার্ক রাউন্ডেও হামিদুলের সঙ্গে সমান তালে লড়তে থাকেন তিনি। মনোরঞ্জনের ১৩৫ কেজির জবাবে এসে ১৪০ কেজি তুলে আটকে যান হামিদুল ইসলাম। পরে সেটা অতিক্রম করার সুযোগ এসে যায় মনোরঞ্জনের। সেই চ্যালেঞ্জটা নিতেও চেয়েছিলেন এই তরুণ। কিন্তু হামিদুল ও ভারোত্তোলন ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখে নাকি সেটা পারেননি তিনি, ‘দেখুন আমি চেয়েছিলাম চ্যালেঞ্জটা নিতে। কিন্তু ড্রেসিংরুমে হামিদুল চিত্কার করে আমাকে বলেন তুমি থাম এবার। অন্য কর্মকর্তারা বলতে থাকেন তোমার দরকার নেই আর ওজন বাড়ানোর। অনেক হয়েছে! হামিদুল সিনিয়র, স্বর্ণপদক তার জন্য।’
এখানেই থামলেন না ২০ বছর বয়সী এই তরুণ। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমার মন খারাপ এ কারণে যে, স্বর্ণপদক জেতার এমন সুযোগ বারবার আসে না। দেখুন এখানে ভারত ও পাকিস্তান ছিল না। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারতাম আমি। কিন্তু আমাকে পারফরম করতে দেয়া হলো না।’
তারপরও রৌপ্যপদক তো এসেছে! সেটাও কম কী? মনোরঞ্জন রায় বলছিলেন, ‘যা কিছুই হোক এটা অবশ্যই আমার জন্য স্মরণীয় একদিন। আজ মা বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক খুশি হতেন। আমার এই পদক আর কারও জন্য নয়, এটি শুধুই আমার স্বর্গীয় মায়ের জন্য!’

বাংলাদেশকে প্রথম স্বর্ণ উপহার দিলেন হামিদুল

ভারোত্তোলনের ৭৭ কেজি ইভেন্টে পদক আসছে, এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আগেই। প্রতিযোগী যখন তিনজন, তখন তো প্রতিযোগিতার মঞ্চে পা দেয়ার আগেই পদক নিশ্চিত! সেই তিনজনের মধ্যে আবার দুজনই বাংলাদেশের। অন্যজন আফগানিস্তানের। তাই লড়াই ছিল স্বর্ণের। সেই লড়াইয়ে আফগানিস্তানের মোস্তফা কামান্দ পিছিয়ে পড়ার পর স্বর্ণের লড়াই শুরু হয় দুই বাংলাদেশী ভারোত্তোলকের। স্ন্যাচ এবং ক্লিন জার্কের সেই লড়াই বেশ জমে উঠেছিল স্বদেশি হামিদুল ইসলাম এবং মনোরঞ্জন রায়ের। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল বুঝি ছোট ভাই একরামুলের পথ ধরে রৌপ্য পেতে যাচ্ছেন হামিদুল। কিন্তু ছোট ভাইকে ছাড়িয়ে গেলেন বড় ভাই হামিদুল। দেশসেরা ভারোত্তোলক হামিদুলই জিতলেন স্বর্ণপদক। ১১তম এসএ গেমসে স্বাগতিকদের এটাই প্রথম স্বর্ণ জয়। চতুর্থ দিনে এসে গতকাল গেমস আঙিনায় বাজলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উডেনফ্লোর জিমন্যাশিয়ামে উড়লো বাংলাদেশের গর্বের লাল-সবুজ পতাকা। গলায় স্বর্ণপদক ঝুলিয়ে পতাকা হাতে উচ্ছ্বাসে ভাসলেন হামিদুল।

এটা বাংলাদেশের জন্য যেমন এবারের গেমসে প্রথম স্বর্ণ তেমনি হামিদুলের এসএ গেমস ক্যারিয়ারেও প্রথম স্বর্ণ। এর আগে ইসলামাবাদ গেমসে রৌপ্য এবং কলম্বোতে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ। তখন অবশ্য তার ইভেন্টেও ছিল ভিন্ন। ৬২ কেজি ইভেন্টে লড়েছেন। কিন্তু এবার ওজন বাড়িয়ে ৭৭ কেজিতে নাম লেখান হামিদুল। তাতেই বাজিমাত! এই স্বর্ণপদক জেতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাবেন ৫ লাখ টাকা।গতকাল স্ন্যাচ রাউন্ডে তোলেন হামিদুল তোলেন সর্বোচ্চ ১১৭ কেজি। এখানে অবশ্য এগিয়েছিলেন বাংলাদেশের আরেক প্রতিযোগী মনোরঞ্জন রায়। ১২০ কেজি তুলে হামিদুলের চেয়ে এগিয়ে যান তিনি।

অন্যদিকে আফগানিস্তানের মোহাম্মদ মোস্তফা কামান্দ পিছিয়ে ছিলেন বেশ খানিকটা। ৯০ কেজি তুলেই হাঁপিয়ে যান যুদ্ধবিধস্ত দেশটির ভারোত্তোলক। ব্রোঞ্জেই সন্তুষ্ট তিনি। ক্লিন ও জার্ক পর্বে এমনিতেই সেরা হামিদুল। মনে হচ্ছিল এখানে তার কাছে পাত্তা পাবেন না অন্য দুই প্রতিযোগী। আফগান তরুণ ১১০ কেজি তুলে থেমে গেলেও বেশ জমে ওঠে হামিদুল এবং মনোরঞ্জনের লড়াই। দুজন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল বুঝি সাফ রেকর্ড না আবার হয়ে যায়। কিন্তু এখানে স্ন্যাচ রাউন্ডের ব্যবধানটুকু কমিয়ে আনেন হামিদুল। তিনি তোলেন ১৪০ কেজি। মনোরঞ্জন থামেন ১৩৫-এ। দুই রাউন্ডে ২৫৭ কেজি তুলে দেশকে এবারের গেমসের প্রথম স্বর্ণপদক এনে দেন হামিদুল। রৌপ্য জিতেন মনোরঞ্জন।

যদিও সেনাবাহিনীর এই সদস্য বলছিলেন ২৫৭ কেজি টপকে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার। কিন্তু তাকে সেই চ্যালেঞ্জ কাজে লাগাতে দেয়া হয়নি।প্রতিযোগিতায় ভারত-পাকিস্তানের ভারোত্তোলক ছিলেন না, তাতে স্বর্ণ জেতার কাজটা একটু সহজ হয়েছে হামিদুলের। কিন্তু পদকের আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। তাইতো সেনাবাহিনীর সিএমটিটি শাখায় কর্মরত হামিদুল বলছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া! এমন একটি দিনের জন্যই আমি অপেক্ষা করেছি। সেই ১৯৯২ সালে ভারোত্তোলন শুরু করেছিলাম। অবশেষে স্বর্ণপদকের দেখা পেলাম। বলতে দ্বিধা নেই এটাই আমার ক্যারিয়ারের সেরা দিন!’ হামিদুলের এমন সাফল্যে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। সাফে পদক ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে সেই ১৯৯৪ সাল থেকে এখন অবধি তিনিই ভারোত্তোলনের সেরা তারকা! তার হাত দিয়েই এবার স্বর্ণপদক এলো। এমন দিনে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলেন হামিদুল। ফিরে গেলেন সেই শৈশবে। জানালেন ফুটবল, ক্রিকেট, হকির মতো এতো খেলা থাকতে কেন ভারোত্তোলনে নাম লেখালেন, ‘আসলে ছোটবেলায় অন্য সবার মতো আমারও প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। কিন্তু আমাদের কুষ্টিয়ার গাংনির মোয়াজ্জেম ভাই আমার চিন্তা বদলে দিলেন। তিনি কিছুটা জোর করেই আমাকে ভর্তি করালেন তার জিমন্যাস্টিকস ক্লাবে। বললেন আমার মধ্যে নাকি ভারোত্তোলকের চেহারা দেখছেন। সেদিন হেসেছিলাম...। আজ মোয়াজ্জেম ভাইয়ের কথা অনেক মনে পড়ছে!’

এমনিতে হামিদুলকে অনুসরণ করে তার অন্য দুই ভাই একরামুল এবং আশরাফুলও ভারোত্তোলনে নাম লিখিয়েছেন। এরই মধ্যে এই গেমসে তার ছোটভাই একরামুল জিতেছেন রৌপ্যপদক। সব মিলিয়ে এখন সুখী মানুষদের একজনই হওয়ার কথা হামিদুলের। কিন্তু সামনের অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ এই সুখী সময়েও তাকে চিন্তিত করে তুলছে, ‘দেখুন এখন হয়তো সংবর্ধনা পাব। কিছু টাকাও পাব। কিন্তু সময় ফুরালে সবাই ভুলে যাবে। অতীতে আমি এমনটাই দেখেছি। ভারোত্তোলনকে ক্রীড়াঙ্গনের বেশিরভাগই মানুষই গুরুত্ব দেয় না। সত্ভাইয়ের মতো মনে করে। হয়তো কিছুদিন পরই আমরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ব।’ এই আশঙ্কা সত্য হলে আসলেই অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে দেশকে স্বর্ণপদক এনে দেয়া এই ক্রীড়াবিদের জন্য, ‘আমার জীবনে সঞ্চয় বলে কিছু নেই। যা উপার্জন করি তার পুরোটাই এই শরীরের পেছনে ব্যয় করতে হয়। জানেন তো আমাদের অনেক নিয়ম মেনে পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। সেসব জোগাড়ে যা উপার্জন করি তার পুরোটাই ব্যয় হয়ে যায়। প্রতিদিন এখন আমাদের দেয়া হয় ৩৭০ টাকা। আগে পেতাম মাত্র ১২০ টাকা! টাকার অংক দেখেই বুঝে নিন কি পাচ্ছি!’

যারা হামিদুলকে সংবর্ধনা দিয়ে স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্বে ভাগ বসানোর অপেক্ষায় তারা কি এই দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছেন?

Monday, February 1, 2010

নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েই খুশি একরামুল

নিজের সীমাবদ্ধতাটুকু ভালো করেই জানেন একরামুল। তাইতো উডেন ফ্লোর জিমন্যাসিয়ামের আট-দশজন দর্শক কিংবা কর্মকর্তাদের মতো আক্ষেপে পোড়েননি তিনি। একটুর জন্য স্বর্ণ পদক হাতছাড়া হয়ে গেলেও হাসতে হাসতেই রৌপ্যজয়ী এই ভারোত্তোলক বললেন, ‘গত কলম্বো এসএ গেমসে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম, এবার রৌপ্য এলো! আমি খুশি। এভাবে এগিয়ে যেতে পারলেই হবে।’ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেই খুশি একরামুল।
কিন্তু গতকাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওই উডেন ফ্লোর জিমন্যাসিয়ামে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ার পাশাপাশি জাতীয় সঙ্গীতও বাজতে পারতো! একটুর জন্য সেটা হলো না! ৫৬ কেজি পুরুষ ভারোত্তোলনে গতকাল শুরুটা দুর্দান্ত হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই তরুণের। স্ন্যাচ পর্বে এক পলকে তুলে নিয়েছিলেন ১০২ কেজি। উল্টোদিকে বাছাই পর্বেই বিদায় নেয় ভারতের ভারোত্তোলক। লড়াইয়ে বাংলাদেশের একরামুল হকের সঙ্গে টিকে থাকেন শ্রীলঙ্কার ওয়াতা আসে কামাল এবং পাকিস্তানের আবদুল্লাহ গফুর। কামাল তোলেন ৯৫ কেজি। আবার গফুর স্ন্যাচে উত্তোলন করেন ৯৭ কেজি। এখানে এগিয়ে যান বাংলাদেশের একরামুল।কিন্তু তখনও বাকি স্ন্যাচ ও ক্লিন রাউন্ড।
এখানে সেই এগিয়ে থাকাটা কাজে লাগানোর সুযোগ এসে যায় একরামুলের। প্রথম দফায় শুরুটাও বেশ ভালো হয় ২০ বছর বয়সী এই তরুণের। উত্তোলন করেন ১২৬ কেজি। পাকিস্তানের আবদুল্লাহ গফুর ১২৫ কেজিতে আটকে গেলে রৌপ্য পদক নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। তখন প্রতীক্ষা এবারের এসএ গেমসের প্রথম স্বর্ণের। সকালে ব্যাডমিন্টন থেকে এসেছিল এবারের গেমসে বাংলাদেশের প্রথম পদক ব্রোঞ্জ। মনে হচ্ছিল, বুঝি এদিনই স্বর্ণের মুখ দেখবে বাংলাদেশ। মুহূর্তেই এখবর ছড়িয়ে পড়ে স্টেডিয়াম পাড়ায়। উডেন ফ্লোর জিমন্যাসিয়ামে উত্সুক কর্মকর্তাদের ভিড় বাড়তে থাকতে।
কে জানতো তখনও সেরা চমকটা লুকিয়ে রেখেছেন ২৫ বছর বয়সী যুবক ওয়াতা আসে কামার? স্ন্যাচ এন্ড ক্লিন রাউন্ডে ১৩৫ কেজি তোলার পরিকল্পনা করেন। তার এই সিদ্ধান্তে চমকে ওঠে সবাই। কিন্তু সেই চমকের রেশ মিলিয়ে না যেতেই দু’দফায় তুলে মাথার ওপর তুলে ধরেন ১৩৫ কেজি ডাম্বেল। এমন ছোটখাটো গড়নের শ্রীলঙ্কান ভারোত্তোলকের মাসলে এতো শক্তি! এরপর সুযোগ এসে যায় সেটা টপকানোর। ২ কেজি বাড়িয়ে ১২৮ কেজি ওজনের ডাম্বেল তোলার চ্যালেঞ্জ নেন একরামুল। সেটা করতে পারলে টাই। পরে আবারো লড়াই!
একরামুল উডেন ফ্লোরে দাঁড়াতেই উত্সুক হয়ে ওঠেন সবাই। কি হয় এই শঙ্কা! কিন্তু বাড়তি ওই দুই কেজি ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না! তুলতে পারলেন না ১২৮ কেজি। আর তাতেই ভারোত্তোলন ৫৬ কেজি বিভাগে স্বর্ণ নিশ্চিত হয়ে যায় শ্রীলঙ্কার ওয়াতা আসে কামালের। তবে হতাশ হওয়ার সুযোগ ছিল না একরামুলের। গত এসএ গেমসে ব্রোঞ্জের পর এবার রৌপ্য—উন্নতি তো হচ্ছেই। তাইতো পদকে চুমু খেয়ে মেহেরপুরের এই তরুণ বলছিলেন, ‘এটা ঠিক, স্বর্ণ জিততে পারলে আরো ভালো লাগতো। আমি নার্ভাস ছিলাম না। তারপরও এটা হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখ নেই! দেখুন আমি এমন পরিবার থেকে উঠে এসেছি যেখানে মন খারাপকে প্রশ্রয় দেই না। আমার ভাই হামিদুল ইসলামও ভারোত্তোলক ছিলেন। ইসলামাবাদ গেমসে দেশকে ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছেন আমার বড় ভাই। এবার আমি পেলাম রোপ্য।’ এখানেই থামলেন না ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এই ভারোত্তোলক। বলছিলেন, ‘গত এক বছর অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ মিলেছে। এখন এসএ গেমস শেষেও এই ধারাবাহিকতা থাকলে আমি এশিয়ান গেমসেও পদক এনে দিতে পারবো। আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন। আশা করছি কমকর্তারা গেমস শেষে আমাকে ভুলে যাবেন না!’
কর্মকর্তারা শুনছেন?

দলীয়করণ, লেজুড়বৃত্তি

এসএ গেমসের জন্য বাংলাদেশ কি এখন সত্যিই প্রস্তুত ছিল?’ গতকাল কোনোরকম ভনিতা না করে প্রশ্নটা করে ফেললেন নেপালের সাংবাদিক মনোজ গিমেরা। প্রশ্নটা সঙ্গত কারণেই করেছেন সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের পঞ্চম দক্ষিণ এশিয়ান গেমস কাভার করতে আসা কাঠমান্ডুর এই সাংবাদিক। ১১তম এসএ গেমস শুরু হয়েছে তিনদিন হয়ে গেছে। কিন্তু সবকিছুই যে এখানে এখনও অগোছালো!
গতকালও অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ভবনে তৈরি মিডিয়া সেন্টারের সংস্কার কাজ চলছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় ধরে চলা ড্রিল মেশিন নিয়ে ঠোকাঠুকির কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে অনেক সাংবাদিককে। এটা তো গেল মিডিয়া সেন্টারের ভেতরের সমস্যা। সেখান থেকে বেরিয়ে যে সাংবাদিকরা অন্য ভেন্যুতে যাবেন তার সুযোগ নেই। শাটল বাসের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও সেটা গতকাল পর্যন্ত কথা হয়েই থেকেছে, বাস্তবতার ছোঁয়া মিলেনি! জুডোর লড়াই দেখতে তাই নিজ উদ্যোগেই সাভার যেতে হলো শ্রীলঙ্কান সাংবাদিক মহিন্দা বিবেলকে। শ্রীলঙ্কান রেডিও লাখান্দার এই সাংবাদিক বলছিলেন, ‘আমি এর আগে কোনো গেমসেই এমনটা দেখিনি। দেশের বাইরে যখনই গেছি গেমস কাভার করতে সঠিক গাইডলাইন পেয়েছি আয়োজকদের কাছ থেকে। এখানে তেমনটা নেই। আমার তো মনে হয় ইসলামাবাদ ও কলম্বো গেমস এর চেয়ে ভালো ছিল। ওরা অনেক আন্তরিক ছিল। এখানে নিজের উদ্যোগেই ভেন্যুতে যেতে হচ্ছে।’
এখানেই শেষ নয়, ভেন্যুতে গিয়েও খুব একটা সহায়তা মিলছে না!গতকাল প্রশ্নগুলো উঠতেই আয়োজক বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ‘দেখুন আমি একা কি করব? যখনই যেটা আমার কানে আসে আমি সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। এখন আপনার কাছে শুনলাম সাংবাদিকদের শাটল গাড়ি নেই, সেটাও সমাধান করব।’ আগামীকাল থেকে হবে— এই বলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন মহাসচিব।
কিন্তু গতকাল সাংবাদিকদের হাতে আসা বিওএ’র তৈরি গেমস গাইড নিয়ে ঠিকই বিব্রত হলেন কুতুবউদ্দিন। ভুলেভরা ওই গাইড গতকাল তুলে দেয়া হয়েছে গেমস কাভার করা সাংবাদিক, প্রতিযোগী, কর্মকর্তা এবং লিয়াজোঁ অফিসারদের হাতে। তথ্যগত একাধিক ভুলে সয়লাব এই গাইড। যা তৈরি করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি শাহরিয়ার আলম। তাইতো রাজনীতি থেকে দূরে থাকেনি এই সঙ্কলন। প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। এই গেমসের সঙ্গে এই ছবির রহস্য কি কে জানে! এখানেই শেষ নয়, তুলে ধরা হয়েছে শেখ মুজিবের সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী। গেমস গাইডে বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে তুলে ধরেছেন হাজারো ভুল তথ্য। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বানানো হয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক। একইভাবে আমার দেশ ক্রীড়া সম্পাদক এম. এম. কায়সারকে দেখানো হয়েছে যে, তিনি কর্মরত জনকণ্ঠ পত্রিকায়। এমন ভুলেভরা গেমস গাইড হাতে নিয়ে বিব্রত বিওএ মহাসচিব কাল বলছিলেন, ‘আমি জানি না ওরা কেন এমন ভুল করল। মহাসচিব হিসেবে এমন ব্যর্থতা আমারই।’ এই বলে এই প্রতিবেদকের সামনেই গেমস গাইডের প্রকাশক শাহরিয়ার আলম এমপির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন কুতুবউদ্দিন। কিন্তু টেলিফোনে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে মহাসচিব জানিয়েছেন ভুলগুলোর জন্য তারা লজ্জিত!
এভাবে অতি উত্সাহীদের এমন কাণ্ড অবশ্য এবারই প্রথম নয়। শোনা গিয়েছিল এসএ গেমসের প্রথম আমন্ত্রণপত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছিল। পরে কয়েকজনের আপত্তির মুখে তা বাতিল হয়। ছাপানো হয় নতুন ডিজাইনের আমন্ত্রণপত্র। আবার শেখ মুজিবের নামে গেমসের নামকরণের কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু গেমসের নিয়ম অনুযায়ী সেটা করা সম্ভব নয় বলে তা বাতিল হয়ে যায়।তারপরও দক্ষিণ এশিয়ার এই গেমসকে ‘দলীয় রাজনীতি’র বাইরে রাখতে পারছেন না অতি উত্সাহীরা! ১৭টি স্বর্ণপদকের টার্গেট নিয়ে এবারের গেমসে লড়ছে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত কোনো স্বর্ণপদক জেতা হয়নি স্বাগতিকদের।
তবে ‘দলীয়করণ, লেজুড়বৃত্তি ও অব্যবস্থনার’— ‘হীরক পদক’(!) এখনই গলায় ঝুলিয়ে ফেলেছেন গেমসের ছোট—বড় কর্তারা!আখের গোছাতে হবে যে!

Saturday, January 30, 2010

সন্ধ্যায় রঙিন স্টেডিয়াম

চোখ ধাঁধানো, জমকালো কিংবা বাংলাদেশে এই প্রথম! এমন কথা গত কয়েকদিন ধরেই বলছিলেন এসএ গেমস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজকরা। তাদের সেই কথায় বিশ্বাস না রেখেও উপায় ছিল না। টাকা যে কথা বলে! এবারের এসএ গেমস বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানে। হিসাবটা মনে রাখুন—৪৮ কোটি টাকা! সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ‘অ্যাকুয়েটিক শো’র রঙ্গিন ছটায় যা একটু আলোক ছড়াল। কিন্তু এই মিনিট পনের বর্ণিল আলোকরশ্মির আলোকমালা ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বাকি পর্বগুলোতে নতুনত্ব ছিল কোথায়?
গতকাল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রায় তিনঘণ্টা স্থায়ী সেই ১১তম এসএ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকাল সোয়া ৪টায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্টেডিয়ামের দুই নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আফগানিস্তানের অ্যাথলিটদের দিয়ে শুরু হয় মার্চপাস্ট। এরপর ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী মার্চপাস্টে অংশ নেয় অন্য ৭ দেশ। মার্চপাস্টে ৪৫৩ সদস্যের বাংলাদেশ দলের পতাকা ছিল কমনওয়েথ গেমসে স্বর্ণপদক জেতা শুটার আসিফের হাতে। এরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহত্ ক্রীড়া আসর ১১তম এসএ গেমসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আকাশ ছেয়ে যায় শান্তির প্রতীক কবুতর এবং বেলুনে।সাবেক ১১ কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদের হাতঘুরে শেষ পর্যন্ত মশাল আসে আরেক কিংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিনের হাতে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি ও সাবেক এই ফুটবলার জ্বেলে দেন ১০০ ফুট উপরে স্থাপিত গেমস মশাল।
এরপর ক্রীড়াবিদদের শপথ!মোবাইল কারাভ্যান দিয়ে তারপরই মাঠে আসেন দেশের তিন জনপ্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমীন এবং শুভ্র দেব। গানে গানে তারা স্বাগত জানান সবাইকে। গেমসের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দু’এক কথা বলার পরই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চারটি লাইন আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের গান অঞ্জলি লহমোরের সঙ্গে নেচে ওঠেন একঝাঁক নৃত্যশিল্পী। যার নেতৃত্বে ছিলেন দেশসেরা দুই নৃত্যশিল্পী শিবলী মুহাম্মদ এবং শামীম আরা নীপা। এমন আয়োজন ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের অংশগ্রহণ ছাড়া চিন্তা করা যায় না। এবার ঠিক প্রজাপতির সাজে তারা হাজির হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেই চেনা গান ‘প্রজাপ্রতি প্রজাপ্রতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা..!’
রঙিন সাজ পোশাকে আসা সেই পারফরমারদের মনে হচ্ছিল বুঝি সত্যি সত্যিই উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়! এই পারফরম্যান্সের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই মাঠে আসে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ছেলেরা। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’—এই গানের সঙ্গে তারা ফুটিয়ে তোলে স্বাধীনতার নানা রূপকচিত্র। সঙ্গে গ্যালারির একপাশে ঢাকা ইডেন কলেজের মেয়েদের ক্যালিসথালিক শো চলেছে! সেখানে অবশ্য রাজনীতিকে দূরে রাখা হয়নি। কারণে অকারণে বেশ কয়েকবারই ভেসে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি! জাগ্রত বাংলাদেশ পর্বের এক পর্যায়ে বাংলার ঐতিহ্যের অংশ ঢোল নিয়ে নামে পারফরমাররা। চলে নাও ছাইড়া দে পাল ওড়াইয়া দে’র সঙ্গে মিক্সড তাকধুম তাকধুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল! সঙ্গীত আর নাচে মনে হচ্ছিল পদ্মার ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে মাঠে!সাঁওতাল বিদ্রোহের গৌরব ইতিহাস ইলা মিত্রের ‘নাচোলের রানী’র গীতিকাব্য পরিবেশনাও ছিল অনুষ্ঠানের কিছু অংশজুড়ে। এখানে ৬০০ সাঁওতাল শিল্পী অংশ নেন।
এমন চেনা ও এর আগে অনেকবার দেখা পর্বগুলো শেষ হতেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের রাতের আকাশ রঙ্গিন হয়ে ওঠে। শুরু হয় অ্যাকুয়েটিক শো। যেখানে লেজার শো’র সঙ্গে জলের বুকে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষদের পাশে দাঁড়ানো বিটলস গায়ক জর্জ হ্যারিসন, ৭ মার্চের ভাষণ সেখানে উঠে এলেও দেশের অনেক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ছিলেন তাদের এই পাণ্ডুলিপির বাইরে!
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সেই প্রত্যাশার বেলুন চুপসে যাওয়ার পর এবার পদকের লড়াই! বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা ১৭টি সোনার পদকের লক্ষ্য নিয়ে আজ থেকেই নেমে পড়বে মাঠ, ট্র্যাক, সুইমিং পুল, কোর্ট আর শুটিং রেঞ্জে। সময় এখন দেখার আমাদের ‘অলিম্পিক’ গেমস কতটা আমাদের হয়ে ওঠে!

Friday, January 29, 2010

আমাদের অলিম্পিক গেমস

কথায় আছে, যায় দিন ভালো যায়! বহুল প্রচলিত এ কথার যৌক্তিকতা বারবার প্রমাণিত হয়েছে আমাদের যাপিত জীবনে। আজ থেকে ঢাকাসহ ৫টি বিভাগীয় শহরে শুরু হচ্ছে এ অঞ্চলের ‘অলিম্পিক গেমস’ বলে পরিচিত এসএ গেমস! অথচ একদিন আগেও খেলার পাতার প্রায় পুরোটাজুড়েই ছিল ক্রিকেট। এর আগে যে দুবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহত্ ক্রীড়া আসর, তখন এমনটা চোখে পড়েনি। ১৯৮৫ ও ১৯৯৩ সালের সে আসর ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে উন্মাদনা ছড়িয়েছিল শুরু হওয়ার মাসখানেক আগেই। দিন গণনায় ব্যস্ত থেকেছে মিডিয়াগুলো! সবাই প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছে কখন শুরু হবে গেমস!
আজ অন্যরকম এক আবহের মধ্য দিয়েই শুরু হচ্ছে এসএ গেমসের ১১তম আসর। যেখানে ক্রীড়াপ্রেমীদের আগ্রহের পারদ নিচেই থাকছে। কিন্তু এরই মধ্যে এ গেমসে অংশ নিতে ঢাকায় চলে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার অপর সাত দেশ আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা। স্বাগতিক বাংলাদেশের অ্যাথলিটরাও ট্র্যাকে কিংবা মাঠে নামার অপেক্ষায়। ২৩টি ডিসিপ্লিনে ১৫৮টি স্বর্ণ পদকের জন্য লড়বেন ২ হাজারেরও বেশি প্রতিযোগী! গতকাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ টাওয়ারে সংবাদমাধ্যমকে যখন এ তথ্য দিচ্ছিলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার তখনও এসএ গেমসের ক্রীড়া স্থাপনাগুলোতে চলছিল হাতুড়ি-বাটালের ঠোকাঠুকির শব্দ!
১৭০ কোটি টাকা বাজেটের এ আসর উদ্বোধনের ২৪ ঘণ্টা আগেও শেষ হয়নি অনেক ভেন্যুর নির্মাণ এবং সংস্কার কাজ। তার চেয়েও বড় কথা গেমস ঘিরে যেমন স্পোর্টস ভিলেজ তৈরি করা হয় এখানে তেমনটা নেই। অনেকটা হযবরল অবস্থার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে সবকিছু! যদিও আয়োজক বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ গতকাল বলছিলেন, ‘এটার সঙ্গে অন্যসব ক্রীড়া আসরকে মেলানো ঠিক হবে না। এটা অলিম্পিক কিংবা কমনওয়েলথ গেমস নয়। আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে ভালো করার চেষ্টা করেছি। আর আপনাদের এটা জানিয়ে রাখছি আয়োজন সবাইকে মুগ্ধ করবেই।’সেই মুগ্ধতা আজ থেকেই শুরু হবে! চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আজ বিকাল সোয়া ৪টায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এ আসরের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপরই থাকছে চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মনোমুগ্ধকর হতে তো বাধ্য। উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠানের পেছনেই যে খরচ হচ্ছে ৪৮ কোটি টাকা! দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি ১৩৩ মিনিটের তিন পর্বের এ অনুষ্ঠানে থাকবে অ্যাকুয়েটিক শো! ফ্রান্স থেকে এরই মধ্যে আনা হয়েছে ১৮ বাই ৪০০ ফুটের পুল! যেখানে জলের ঝড় তুলে সবাইকে মুগ্ধ করার প্রতীক্ষায় পারফরমাররা। মোট ২২ হাজার পারফরমার যুক্ত হচ্ছেন এ আয়োজনে।উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠানই কিন্তু গেমস নয়। মাঝের ১০ দিনই হবে সত্যিকারের গেমস। পদক জয়ের জন্য অ্যাথলিটরা গতির ঝড় তোলার চেষ্টায় থাকবেন ট্র্যাকে। জলের বুকে ঝড় তুলবেন সাঁতারুরা। শুটাররা খুঁজবেন সঠিক নিশানা! আর এখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা স্বর্ণের দেখা পেলেই এদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে সত্যিকার অর্থে জমে উঠবে গেমস। এবারের এসএ গেমসে ১৭টি সোনার পদক জয়ের প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে অনেক ডিসিপ্লিনের অ্যাথলিটরা অনুশীলন শুরু করলেও অনেকের মনে আছে আক্ষেপ। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে অনেক অ্যাথলিটের প্রস্তুতির ঘাটতিও থাকছে!
রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি অন্য ৪ বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা এবং সিলেট প্রস্তুত। আজ থেকে ক’দিন হয়তো সবার জীবনযাত্রায় যোগ হবে নতুন এ অধ্যায় এসএ গেমস। স্টেডিয়ামমুখী যারা হতে পারবেন না তাদের জন্য থাকবে টেলিভিশনে সরাসরি ২৩ ডিসিপ্লিনের পদক জয়ের লড়াই দেখার সুযোগ। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে বসানো হবে ১৭টি জায়ান্ট স্কিন!এরই মধ্যে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লেগে থাকা ব্যানার-ফেস্টুনের সংখ্যা বেড়েছে! জাতীয় পাখি দোয়েলের নতুন নতুন সাজ চোখে পড়ছে সবার।
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন কাল নিশ্চিত করেছে স্পোর্টস ভিলেজ না করতে পারলেও পুরো বাংলাদেশই সাজবে নতুন সাজে! হাজারো সমস্যা ঘিরে থাকা দেশের ১৫ কোটি মানুষ কিছুদিন অন্তত উত্সবের অনুষঙ্গ পাবে। প্রত্যেক ক্রীড়াবিদের জন্য দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরার এইতো সুযোগ!

Monday, December 14, 2009

দাদাগিরি আনলিমিটেড

বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমার অধ্যায় শেষ হয়েছে সেই আশির দশকে। মহানায়ক না ফেরার দেশে চলে গেছেন ১৯৮০ সালের অপয়া ২৪ জুলাই! দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও রোমান্টিক ছবির প্রসঙ্গ উঠলে এখনও সেই উত্তম কুমারে ফিরে যায় সবাই। যেমনটা হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। ভালোবাসা কিংবা বিরহ, আমাদের যাপিত জীবনের যে কোনো আবেগ প্রকাশের জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির ওই মহাপুরুষটির সাহিত্যকর্মই তো বাঙালির অবলম্বন! তার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় সবকিছু!রবি ঠাকুরকে ছাপিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস এখনও কেউ দেখায়নি ভারতবর্ষে। সেটার বোধকরি সুযোগও নেই! কিন্তু উত্তম কুমারের সেই চিরায়ত রোমান্টিক ইমেজ একজন ঠিকই পেরিয়ে যেতে পারতেন। একজন ঠিকই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারতেন তার ওই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। তেমনটাই মনে করেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা চিন্ময় রায়! তিনি এমন একজন মানুষের নাম বলেছেন যেটি শুনে আবার বিষম খাবেন না। সৌরভ গাঙ্গুলী—ভুল পড়েননি, সৌরভ গাঙ্গুলীই। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা এই অধিনায়ক যদি সিনেমায় নামতেন, উত্তমের মতোই সফল হতেন কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু!চিন্ময় রায়ের কথায় ‘যদি’র ব্যাপারটা থাকছে বলে ওই প্রসঙ্গ তুলে রাখাই ভালো! কিন্তু মহারাজ সৌরভ যে বাঙালির ‘বোকা বাক্সে’ রীতিমত আলোড়ন তুলেছেন। মাঠে সেই স্টেপ আউট করে ছক্কা মারার মতোই টেলিভিশন অ্যাঙ্করিংয়েও ম্যাজিক। একেবারে শান্ত গলায় ভণিতাবিহীন তার সেই উপস্থাপনায় ‘দাদাগিরি’ নামের অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা ওপার বাংলা ছাপিয়ে আছড়ে পড়ে এখানেও। টিআরপি রিপোর্ট বলছে, দুই বাংলা মিলিয়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান এটিই।লর্ডসের ব্যালকনিতে ইংরেজদের সেই নাক উঁচু মানসিকতাকে একহাত দেখিয়ে জার্সি খুলে লাফানো সৌরভকে এবার দেখা গেছে সম্পূর্ণ অন্য ভূমিকায়। সেই অ্যাগ্রেসিভ ব্যাপারটা উধাও। কুইজ শো’র আদলে তৈরি অনুষ্ঠানের প্রতিযোগীদের সঙ্গে মিশে গেলেন ঠিক পাশের বাড়ির ছেলের মতো। সেই তারকা ইমেজের বালাই ছিল না। আর তাই তো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপ্যাধায় থেকে শুরু করে যারাই অতিথি হয়ে এসেছেন সৌরভের, তারাই মুগ্ধ হয়েছেন উপস্থাপনায়। অনেকেই সবুজ মাঠের ২২ গজে ব্যাট হাতে শাসন করা সৌরভের টিভি পর্দায় সাবলীল উপস্থাপনা দেখে অবাক হয়েছেন। তবে সেই অবাক হওয়াদের দলে নেই ইরফান পাঠান। একটি পর্বে তিনিও ছিলেন দাদাগিরি’র অতিথি। ভারতীয় দলের এই অলরাউন্ডার বলছিলেন
—‘পেশাদার উপস্থাপকদের চেয়ে দাদার (সৌরভ) এমন ভালো উপস্থাপনা দেখে আমি কিন্তু অবাক
হচ্ছি না। আমি
আগেও বলেছি, কমেন্ট্রিতে গেলে দাদা সেরাদের একজন হতেন! অসাধারণ ব্যক্তিত্বই এগিয়ে
দেয় সৌরভকে।'
অথচ ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেলে দেড় ঘণ্টার সেই কুইজ অনুষ্ঠান শুরুর আগে তেমন প্রস্তুতি ছিল না সৌরভের। অবশ্য তিনি নিজেও ভাবেননি, সপ্তাহের তিন দিন রাতে চলা এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে এমন উন্মাদনা হবে। ৬ মাস চলার পর এখন শেষ প্রান্তে তার এই দাদাগিরি। কিন্তু চ্যানেলটির কর্তাব্যক্তিরা কিছুতেই ছাড়ছেন না তাকে। এরই মধ্যে তার হাত দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে তাদের অ্যাকাউন্টে। সৌরভের অনুষ্ঠান মানেই স্পন্সরদের লম্বা লাইন। মুম্বাইয়ের পত্রিকা মিড-ডে জানাচ্ছে, দাদাগিরি নাকি শুধু বাংলায় নয়, হিন্দিতেও হবে। ভারতীয় জাতীয় অনুষ্ঠানের মর্যাদা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে এটি।তবে আপাতত লাইট-ক্যামেরা অ্যাকশনের পর্ব শেষ! আগামী সপ্তাহে শেষ হবে দাদাগিরি’র প্রথম পর্ব। সৌরভ ব্যস্ত হয়ে পড়বেন কলকাতা নাইট রাইডার্স নিয়ে। আইপিএল ভাবনা এখন মাথায়। তাই টিভি পর্দার লাজুক আর রোমান্টিক নায়কের চেহারা নিয়ে উপস্থাপনা করা সৌরভকে ভুলে যান। কেননা, এবার যে মাঠের গুগলি অপেক্ষায় আছে তার!অনেকটা রূপকথার জাদুকরের মতো সৌরভ যেটাতেই হাত দিয়েছেন সেটাই সোনা হয়েছে! এবার শেষের শুরুটা ভালো করার মিশন! এরই ফাঁকে চিন্ময় রায়ের প্রস্তাবটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে কিনা কে জানে? মহারাজ চাইলে ঠিকই পারেন!

Sunday, October 11, 2009

গাহিয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম...


সদ্য প্রয়াত বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম যেমনটা গেয়েছিলেন-‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’- আসলেই তাই, আগের দিনগুলোই বরং সুন্দর ছিল আমাদের। বিনোদনের জন্য এমন নৌকাবাইচ কিংবা আরও অনেক অকৃত্রিম খেলা বেছে নেয়া হতো। কিন্তু দিন পাল্টে গেছে, এখন এই প্রজন্মের কিশোর-তরুণরা কম্পিউটার গেমস কিংবা এ জাতীয় কৃত্রিম আনন্দতেই গা ভাসিয়ে দেয়! আমাদের গ্রামগুলোও পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। তারপরও মাঝে মধ্যে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। নদীপ্রধান বাংলাদেশে চলে নৌকাবাইচ। এ মাসের শুরুতে নরসিংদীর মেঘনা নদীতে এমনই এক নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই আয়োজনে এখনও যে সবার আগ্রহ আছে সেটাই দেখা গেছে। হাজারো উৎসুক মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখেছে মাঝিমাল্লাদের এই লড়াই।

কিন্তু কথা হলো, দু-একটা বিচ্ছিন্ন আয়োজন কি বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠা এই গ্রামবাংলার লড়াইকে? মনে হয় না। এখনই পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হয়তো হারিয়েই যেতে পারে নৌকাবাইচের মতো নির্মল বিনোদন। তখন হয়তো ভাটি অঞ্চলের বাউল সম্রাটের ওই গান আরও বেশি আবেদন নিয়ে ধরা দেবে আমাদের কাছে!